অগ্নিভ সেনগুপ্ত
বুঝলেন মশাই, ভালোবাসা ব্যাপারটা বেশ জটিল। হাজার বছরে বাঘা-বাঘা দার্শনিকরা যার কূলকিনারা করতে পারলেন না, হাজার শব্দের মধ্যে তার ব্যাখ্যা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। যাক, চেষ্টা করে দেখি।
কবিগুরুর ব্যাখ্যান দিয়েই শুরু করা যাক। “সখী, ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?” হ্যাঁ, কিছুক্ষেত্রে যাতনাময় তো বটেই। কারণ, কিছু ভালোবাসা আমাদের উপরে আরোপিত করা হয়। যেমন ধরুন, আপনার হয়তো সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা একদম জঘন্য লাগে। কিংবা, রবীন্দ্রসংগীত শুনতে বসলেই ঘুম পেয়ে যায়। অথবা, দুর্গাপূজার ভীড় দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। কিন্তু, দাদা, বাঙালী হয়েছেন, এইসব ভালো না বাসলে চলে? সমাজ কি আপনাকে মেনে নেবে? অগত্যা, পাঁচন গেলার মতোই আপনাকে ভালোবাসা গিলতে হয়।
এ তো গেল সাংস্কৃতিক আঙ্গিক। সামাজিক বা পারিবারিক ক্ষেত্রেও কি সেই আরোপিত ভালোবাসা আমাদের গলা টিপে ধরে না? উদাহরণ বিরল নয়, যেখানে এক ছাদের নীচে বসবাস করেও মানসিক দূরত্ব অনতিক্রম্য। তবুও সমাজের সামনে ভালোবাসার অভিনয় করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত।
আবার তার বিপরীত উদাহরণও বিরল নয়, সামাজিকতা প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের কাছে যাওয়ার পথে। অর্থাৎ, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ইজ ডাইরেক্টলি প্রপোরশনাল টু সামাজিকতা।
আবার, কিছু ভালোবাসার ভার আপনার জন্মলগ্নেই চাপিয়ে দেওয়া হয় আপনার উপরে। মা-বাবা যেমনই হোক না কেন, তাদের ভালোবাসতেই হবে। দেশ আপনার উপরে যতই অত্যাচার করুক না কেন, দেশকে ভালোবাসতেই হবে। বেশীরভাগ জঙ্গি সংগঠনের প্রধান মস্তিস্কপ্রক্ষালক মন্ত্র – তোমার ধর্ম সংকটে। আচ্ছা, একটা কথা বলুন, যা নির্বাচন করার কোন সুযোগ আমরা পাইনি, ঘটনাক্রমে জন্মসূত্রে পেয়েছি মাত্র, তাকে ভালোবাসার দায় কিভাবে আমাদের উপরে বর্তায়?
ইদানীং কিছু শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বদেশ এবং স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা একটু বেশী প্রকট হয়ে উঠছে। সে তো ভালো কথা, কিন্তু তাঁদের সেই ভালোবাসার ঢেউয়ের প্রাবল্য এতো বেশী যে সম্ভবত দেশমাতৃকারও প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাঁদের মতো করে ভালোবাসলেই নাকি আপনি সাচ্চা দেশপ্রেমিক, নাহলে নয়। সুকুমারীয় ভাষায়, না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব। যে ভালোবাসা প্রকট করতে নিজের দেশবাসীকে অপদস্ত করতে হয়, প্রয়োজনে প্রাণ কেড়ে নিতে হয়, সে ভালোবাসা কি সত্যি ভালোবাসা নাকি ক্ষমতা প্রদর্শনের অজুহাত-মাত্র – তা ঠিক বলতে পারব না।
এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রান্তিক ভালোবাসার একত্রিত যোগফল কিছুটা প্রকট হয় আইনের পাতায়। কে কাকে কতটা ভালোবাসবে, অনেকক্ষেত্রেই তা নির্ধারণ করে দেয় বিচারসভা। যেমন, কিছুদিন আগে পর্যন্ত সমকামিতা ভারতবর্ষে অবৈধ ছিল। অর্থাৎ, কেউ যদি সমলিঙ্গের প্রতি ভালোবাসার টান অনুভব করে, তা প্রকাশ করা বেআইনী। সুপ্রীম কোর্টকে ধন্যবাদ, এখন আইনের খাতায় সমকামিতা অপরাধ নয়। কিন্তু, সমাজের খাতায়? এক বিখ্যাত সমাজসেবী সংগঠনের প্রধান তো বলেই দিয়েছেন, কোর্টের আদেশ শীরোধার্য, কিন্তু সমকামিতা তাঁদের চোখে এখনো অসামাজিক এবং অনৈতিক। তাই বলে ভাববেন না যে বিপরীতকামিদের ভালোবাসার জীবন ইজ আ বেড অফ রোজেস্! সেখানে চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে জাতি, গোত্র, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির মতো দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। অনার কিলিং-এর উদাহরণ তো বিরল নয়!
যাক, এইবার আসল প্রশ্নে আসা যাক – ভালোবাসা কি? বৈজ্ঞানিকরা বলবেন, হরমোনাল রিয়্যাকশন। বা, নিউরোনের মধ্যে বিশেষ বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আদান-প্রদান। কিন্তু, সে তো অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়া। আমি-আপনি ইচ্ছা করলেই তো আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না! অথচ, সেই ভালোবাসাকেই নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, কিংবা রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে সমাজ। আইনের অবশ্যই সে অধিকার আছে – যদি আপনার ভালোবাসা সমাজের ক্ষতিসাধন করে। মানে, ধরুন, কারোর ভালোবাসা হচ্ছে মানুষ খুন করা। তার জন্যে আইনী হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু, আপনি কাকে ভালোবাসবেন, কি খেতে ভালোবাসবেন, কি পরতে অথবা পড়তে ভালোবাসবেন – সেটা তো আপনার নিজস্ব। এবং, কারোর ক্ষতিসাধন না করেই।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই ভালোবাসার স্বাধীনতাটুকুও অনেকক্ষেত্রে অবর্তমান, এমনকি বর্তমান প্রগতিশীল সমাজেও। তাই, আমার মনে হয়, কিছু-র আকাঙ্খা অনেকের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার নামই ভালোবাসা। সেই আকাঙ্খার চাপে আপনি অনেক সময় আপস করে নেওয়াকেই ভালোবাসার নাম দিয়ে দেন। আর, নিরন্তর সেই আপস থেকেই হয়তো ভালোবাসার নামে হিংসা জন্ম নেয়। আর, তাকে জাস্টিফাই করার জন্যে আমরা অজুহাত হিসাবে বলি, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। যদি তাই হয়, তাহলে যুদ্ধবন্দীকে গ্যাস চেম্বারে ঠেলে দেওয়া রাষ্ট্রনেতাও ফেয়ার, এবং প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের দ্বারা প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারাও ফেয়ার।
পাঠকমশাই মনে মনে ভাবছেন, অনেক তো বিজ্ঞের মতো বক্তব্য রাখলে, তাহলে সমাজে কেমন ভালোবাসা চাও হে! না, আমি উদ্দামতার পক্ষে নই (হয়তো, ক্রমবর্ধমান বয়সের কারণেই)। কিন্তু, মুক্ত অর্থনীতির মতো মুক্ত ভালোবাসার সমাজই কাম্য। বহুত্বের মধ্যেই ঐক্য, তাই তো এক সুস্থ সমাজের লক্ষণ। তাই তো আমাদের বহু আকাঙ্খিত ভালোবাসা – বিবিধের মাঝে মিলন মহান!