অগ্নিভ সেনগুপ্ত
আদিম যুগ থেকে মানুষ গল্প বলতে চায়, গল্প শুনতে চায়। অভিজ্ঞতার সঙ্গে উর্ব্বর কল্পনার মিশ্রণে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গল্পের প্রচলন সমৃদ্ধ করেছে মানবজাতিকে। শুধুমাত্র কথিত উপাখ্যান নয়, আদিম গুহামানব গুহার দেওয়ালে রঙের আঁচড়েও বলে গেছে অনেক গল্প। আলতামিরার বাইসন, বা সদ্য-প্রাপ্ত ইন্দোনেশিয়ার গুহাচিত্র আদিম জনজীবনের কাহিনী ব্যক্ত করেছে আজকের যুগে।
সময়ের সাথে-সাথে মানুষ লিপির জন্ম দেয়। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর শিলালিপি, বা ইজিপ্সিয়ান হাইরোগ্লিফিকস তৎকালীন সমাজের গল্প বলে চলেছে ক্রমাগত, আজকের যুগেও। কিন্তু, মূলত তা ছিল তৎকালীন জনজীবনের রোজনামচা, অথবা সরকারী নথি। প্রকৃত অর্থে মহাকাব্যগুলিকে গল্প বা উপন্যাসের জনপ্রিয় উদাহরণ বলা যেতে পারে, সে আমাদের রামায়ণ-মহাভারত হোক, বা গ্রীকদের ইলিয়াড-ওডিসি।
এখন যদিও অনেকেই মহাকাব্যকে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস করছেন বিভিন্ন উদ্দেশ্যে।কিন্তু, ঐতিহাসিকদের মতে, প্রধানত তৎকালীন সমাজের প্রকৃত প্রতিচ্ছবির সঙ্গে লেখকের (বা, লেখকদের) কল্পনার মেলবন্ধনই মহাকাব্যের উৎস। পুরাকাল থেকে আজকের দিনেও মূলত সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন লেখকের ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিস্থিতির দর্শন।
যেকোন গল্পকেই কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, যাকে বলা হয় স্টোরি স্পাইন বা গল্পের মেরুদন্ড। লেখক সেই মেরুদন্ড বা কাঠামোর উপরেই ভিত্তি করে গড়ে তোলেন তাঁর সাহিত্যকীর্তি। প্রধান উদ্দেশ্য, পাঠকের কাছে সেই গল্পের মূল বা মোরাল তুলে ধরা, যাকে বলা যেতে পারে সেই গল্পের আত্মা।
২৮শে ডিসেম্বর, ১৮৯৫। প্যারিস। ল্যুমিয়েঁ ভ্রাতৃদ্বয় পৃথিবীকে দেখালেন (হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই) যে শ্রুত বা পঠিত মাধ্যমের বাইরেও গল্প বলা যায়। চলচ্চিত্র। তার আগেও অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম অবশ্যই ছিল – লাইভ থিয়েটার। কিন্তু, চলচ্চিত্র যেহেতু চলমান চিত্রের সংকলন, সুতরাং গল্পের সূক্ষ্মতা ব্যক্ত করার মাধ্যম আরো উন্নত হয়ে উঠল। থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র-মাধ্যমের তুলনামূলক আলোচনা বিস্তৃত একটি বিষয়, এবং এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্যও নয়।
অবশ্যই, জন্মলগ্নে চলচ্চিত্র-মাধ্যম ছিল দুর্বল এবং তৎকালীন অন্যান্য জনপ্রিয় মাধ্যমের তুলনায় অপরিণত। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে সেই মাধ্যম জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে। ১৯২৭ সালে মুক্তি পেল প্রথম সবাক চলচ্চিত্র (বা, টকিং মুভি) – দ্য জ্যাজ সিঙ্গার। তার নয় বছর আগে, অর্থাৎ ১৯১৮ সালেই মুক্তি পেয়ে গেছে প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র – দ্য কিউপিড অ্যাংলিঙ। নাবালক থেকে সাবালক হয়ে উঠল চলচ্চিত্র-মাধ্যম, এবং আজকের যুগে বিনোদন-শিল্পের শীর্ষে বসে আছে বললে অত্যুক্তি করা হবেনা হয়তো।
সময়ের সাথে সাথে চলচ্চিত্র-নির্মাণের পদ্ধতি বদলেছে। আগেকার তুলনায় এখনকার যুগে ফিল্মমেকিং খুব ব্যয়সাপেক্ষ শিল্প নয়, তাই বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি অনেক পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রও প্রকাশিত হচ্ছে। পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের মতোই সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্বল্প-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। এমনকি অ্যাকাদেমি অ্যাওয়ার্ড বা কানের মতো উচ্চমার্গের চলচ্চিত্র-উৎসবেও স্বল্প-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র স্থান করে নিচ্ছে অনেকদিন ধরেই।
ব্যক্তিগত মতামত, ছোটগল্প লেখার মতোই স্বল্প-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রকরণ পূর্ণ-দৈর্ঘ্য নির্মাণের তুলনায় কোনভাবেই স্বল্প নয়। বিশেষত, চিত্রনাট্য। সীমিত সময়ের মধ্যে (সর্বাধিক ৪৫ মিনিট) একটি সম্পূর্ণ গল্পকে উপস্থাপনা করা দুঃসাধ্য প্রয়াস।
তবে, স্বল্প-দৈর্ঘ্যের সিনেমা ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে সিনেমা-প্রেমীদের মধ্যে। প্রথমত, এখনকার ব্যস্ত জীবনে আড়াই-তিন ঘন্টা বসে পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের সিনেমা দেখার অলস সময় কম। তাই, ব্রেকফাস্ট করতে-করতে বা ডিনার টেবিলে চট করে ১৫-২০ মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম দেখে নেওয়া পছন্দ করছেন অনেকেই। দ্বিতীয়ত, যেহেতু শর্ট ফিল্ম প্রযোজনা তুলনায় কম ব্যয়সাপেক্ষ, অনেকেই সাহস পাচ্ছেন নতুন গল্প, নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করার। এবং, সেই প্রয়াসকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে চলেছে বিভিন্ন শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তা ছাড়া, ইউটিউব বা ভিমিও-এর মতো সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম তো আছেই।
এখনকার ডিজিট্যাল যুগে মোবাইল ফোনের অভাবনীয় উন্নতির সাথে শর্ট ফিল্ম বানানোর সাধন আক্ষরিক অর্থেই আমার-আপনার হাতের মুঠোয়। এখনকার বেশীরভাগ মোবাইল ফোনেই হাই-ডেফিনিশন ভিডিও শ্যুট করা সম্ভব। অর্থাৎ, আপনার যদি সিনেম্যাটোগ্রাফি সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান থাকে, তাহলে আপনি প্রায় বিনামূল্যেই একটি শর্ট ফিল্ম বানিয়ে নিতে পারেন।
যেকোন চলচ্চিত্রের মেরুদন্ড হচ্ছে গল্প বা চিত্রনাট্য। বাকি সবকিছুই তার আনুসঙ্গিক, সেই গল্পটাকে উপস্থাপন করার মাধ্যম-মাত্র। সুতরাং, আপনি মোবাইল ফোনে শ্যুট করুন বা উচ্চমানের 8K ক্যামেরায়, আপনার চিত্রনাট্য ভালো না হলে তা দর্শকের মনে দাগ কাটবে না।
মাধ্যম আয়ত্তে এসে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন শর্ট-ফিল্ম উৎসব ও সোশ্যাল মিডিয়ার কাঁধে ভর করে এখন অনেকেই স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করছেন। অর্থাৎ, কোন প্রযোজক সংস্থার সাথে যুক্ত না হয়ে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়াই। ইদানীং ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিং-এর পালে নতুন হাওয়া দিয়েছে। অন্যরকম কাজ করার পাশাপাশি কিছু অর্থ উপার্জনের রাস্তাও করে দিচ্ছে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।
নেদারল্যান্ডসের ভারতীয় কম্যুনিটির মধ্যেও কয়েকজন স্বাধীন চলচ্চিত্র-প্রযোজনা করছেন। তাঁদের সাথে আলোচনা হল বিদেশের মাটিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিং-এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে।
সুদীপ্ত চক্রবর্তী জানালেন, প্রাথমিক সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব। সুদীপ্ত পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি-কর্মী । পাশাপাশি নিজের শখে শর্ট ফিল্ম বানান, যা ওনার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়।
ওনার কথায়, শুধুমাত্র সরঞ্জাম নয়, পেশাদার অভিনেতা অথবা টেকনিশিয়ানের অভাব প্রকট। একই সুর এক অন্য ফিল্মমেকার অক্ষয় মহাশব্দের কথায়। অক্ষয়ও নিজের পেশাগত কারণে নেদারল্যান্ডসের বাসিন্দা, এবং স্বাধীন চলচ্চিত্র-নির্মাণ করেন নিজের চ্যানেলের জন্যে। অক্ষয় আরো বলেন, ভারতবর্ষে বহুস্তরীয় সমাজ ব্যবস্থার কারণে সেখানে চিত্রনাট্যের পটভূমির বিস্তৃতি অনেক বেশী। তবে, নেদারল্যান্ডসের নরম আলো সিনেম্যাটোগ্রাফির জন্যে শ্রেয়, জানালেন অক্ষয়।
কথা হলো আর-এক ফিল্মমেকার প্রসাদ সাওন্তের সাথে। প্রসাদের ভারতবর্ষে ফিল্মমেকিং-এর অভিজ্ঞতা নেই, নেদারল্যান্ডসে অন্যান্যদের মতোই নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্যে শর্ট ফিল্ম বানান। ওনার কথাতেও একই সুর, নেদারল্যান্ডসে পেশাদার ফিল্মমেকিং-এর পথ বেশ দুর্গম। বিশেষত, ওনার কথায় ফুটে উঠছিল প্রশিক্ষিত অভিনেতার অভাবের আক্ষেপ। তবে, উনি মনে করেন, আগ্রহী অভিনেতারা যদি নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করেন, তাহলে অবশ্যই সেই খামতি মেটানো সম্ভব।
নেদারল্যান্ডসে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিং-এর উন্নতি সাধনের জন্যে, বিশেষত ভারতীয় কম্যুনিটির নির্মাতাদের প্রধান করণীয় কি? এই প্রশ্নের উত্তরে তিন ফিল্মমেকারের একই সুর – নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, এবং একে অপরের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
তবে, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, তার সাথে প্রয়োজন দর্শকদের সহায়তা। একজন নির্মাতা মূলত শিল্প সৃষ্টি করে দর্শকদের জন্যেই। কিন্তু, সেই দর্শকদের থেকে যদি কোন প্রতিক্রিয়া না পাওয়া যায়, তাহলে সেই শিল্পকর্মের মূল্য কমে যায়। তাই, আপনারা যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের কাছে একান্ত অনুরোধ – নির্মাতাদের শিল্প দেখুন, এবং আপনার প্রতিক্রিয়া জানান। সমালোচনা করুন।
যেকোন ফিল্মমেকারের কাছে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র তাঁর সন্তানের মতো। তাই, সেই চলচ্চিত্রের খারাপ দিকটা অনেক সময়েই তিনি দেখতে পান না। দর্শকের প্রধান কর্তব্য, সেই উন্নতিসাধনের রাস্তাটা দেখিয়ে দেওয়া।
যাঁরা এই লেখাটা পড়ছেন, তাঁদের কাছে একটা অনুরোধ রেখে নটে গাছটা মুড়াবো। সুদীপ্ত, অক্ষয়, প্রসাদ, বা আপনার চেনাশুনা যাঁরা সীমিত সামর্থে চলচ্চিত্র-নির্মাণের চেষ্টা করছেন, তাঁদের সহায়তা করুন। ওনাদের শর্ট ফিল্মগুলো দেখুন, ভালো লাগলে আপনাদের বন্ধু-আত্মীয়দের সঙ্গে শেয়ার করুন। ভালো না লাগলে কমেন্টে জানান। আখেরে তাঁদের যেমন তাতে লাভ হবে, আপনারাও ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু সিনেমা উপহার পাবেন।
কে বলতে পারে, আগামী দিনে নেদারল্যান্ডসে হয়তো ভারতীয় কম্যুনিটির থেকে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানাতেও কেউ এগিয়ে আসবেন আপনার সহায়তায়!
এই সূত্রে বলে রাখি, আমি নিজেও চেষ্টা করি শর্ট ফিল্ম বানানোর। আমার ইউটিউব চ্যানেলে সেই কাজ আপনারা দেখতে পারেন।
ভালো থাকবেন, দেখতে থাকবেন, আর জানাতে ভুলবেন না আপনাদের মতামত।