অগ্নিভ সেনগুপ্ত
সিনেমার বিষয়ে সাধারণতঃ আমি খুব-একটা লিখি না, কারণ মোটামুটি সব সিনেমাই আমার, কেন জানি না, ভালোই লাগে। তা ছাড়া, এখন বিভিন্ন কাজের চাপে নিয়মিত সিনেমা দেখার অভ্যাসটাও নেই। তার কিছু কারণ আছে। আমার মূলতঃ ডার্ক থ্রিলার জঁরের সিনেমা বেশী পছন্দের, যা সাধারণতঃ পরিবারের সাথে বসে দেখা যায় না। আর, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরলে বেশীক্ষণ জেগে বসে সিনেমা দেখাও যায় না, পরের দিন মেয়ের স্কুল, নিজের অফিস ইত্যাদির তাড়নায়।
এখন বিশ্ব জুড়ে লকডাউন / সেল্ফ-আইসোলেশনের সময়ে এইটা একটা মস্ত সুবিধা হয়েছে, সাত-তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। তাই, দিনের শেষে কয়েক ঘন্টা পেয়ে যাই নিজের পছন্দমতো সিনেমা দেখার জন্যে। এই কয়েকদিনে গোটা দশেক সিনেমা দেখে ফেললাম, এবং (আবার) উপলব্ধি করলাম – বাংলা বা হিন্দী ভাষায় ডার্ক থ্রিলারের সংখ্যা বেশ নগণ্য। বেশীরভাগই নির্দেশকই থ্রিলারের নামে রগরগে কিছু খুনের দৃশ্য, অতিনাটকীয় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর গোটাকয়েক কাঁচা খিস্তি মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি পরিবেশন করছেন, যা বেশীক্ষণ বসে দেখা যায় না। এখনো মনে করার চেষ্টা করছি, কে আমাকে থ্রিলারের নামে ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ সাজেস্ট করেছিল! তাকে ভগবান ক্ষমা করবেন না!
ঠিক আছে, ধরে নিলাম যে ‘মাইন্ড হান্টার’-এর মতো রিয়েল লাইফ থ্রিলার প্রত্যেকদিন হয় না, কিন্তু সত্যির সাথে একটু ঊর্বর কল্পনা মিশিয়ে অন্ততপক্ষে ‘রমন রাঘব ২.০’ তো আরো দু-চারটে বানানো যায়! এই ছিল আমার আক্ষেপ। ছিল, কারণ গতকাল দেখলাম – ‘পোশাম পা’। এই রোজকার ডাল-ভাতের বাজারে উৎকৃষ্ট বিরিয়ানি না হোক, উৎকৃষ্ট মাংস-ভাত তো বটেই!
অবশ্য, হতে পারে, বহুদিন ভালো থ্রিলার না দেখার সুবাদে আমার প্রত্যাশা নিম্নগামী। সামান্য অন্য ধরণের কিছু দেখলেই সেটা অসম্ভব ভালো লেগে যায়। তাই, পরীক্ষা প্রার্থনীয়! নিজে দেখুন, নিজে বিচার করুন। আমি শুধু আমার নিজস্ব ভালোলাগা-খারাপ লাগা, এবং তার সপক্ষে কিছু তথ্য এবং যুক্তি সাজিয়ে দিতে পারি।
প্রথমে, গল্পে আসা যাক। এই গল্প সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে নাসিক, কোলাপুর ও পুনে থেকে প্রায় ৪০ জন শিশুকে অপহরণ, তাদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো, এবং তার মধ্যে ১২ জনকে খুন করার অপরাধে গ্রেফতার হন অঞ্জনা গাভিট, এবং তার দুই কন্যা রেণুকা শিন্দে ও সীমা গাভিট।
আদালতের বিচার শুরু হওয়ার আগেই অঞ্জনা গাভিট মারা যান।
বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালে । ২০০১ সালে সেশন কোর্টে ৬টি খুন প্রমাণিত হয়, এবং অভিযুক্তদের (এক্ষেত্রে, রেণুকা এবং সীমা) ফাঁসির আদেশ শোনানো হয়। সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন অভিযুক্তরা, কিন্তু সেখানেও ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জ্জী অপরাধীদের কৃপাভিক্ষাপত্র না-মঞ্জুর করেন, এবং তাঁরা এখনো তাঁদের মৃত্যুদন্ডের দিন গুনছেন।
খুব সংক্ষেপে লিখলাম। আপনাদের যদি ঘটনাটা বিশদে জানার ইচ্ছা থাকে, একটু কষ্ট করে সার্চ করে নেবেন।
মূল বক্তব্য, যেটা সিনেমাটার প্রধান বিষয় – প্রবৃত্তি বনাম প্রতিপালন, নেচার ভার্সাস নার্চার। দুই বোনের এই হিংস্র স্বভাবের জন্যে কোনটা দায়ী? নাকি, দুটোই সমানভাবে দায়ী?

মাইন্ড হান্টারের মতোই পোশাম-পা সাইকোলজিকাল প্রোফাইলিং নিয়ে গল্প। গল্পের মূল চরিত্রে দুই বোন, রেঘা শাঠে (সায়নী গুপ্ত) এবং শিখা দেশপান্ডে (রাগিনী খান্না)। দুজনেই ফাঁসির আসামী। অপরাধ খুব গুরুতর, প্রায় পঞ্চাশজন বাচ্চার অপহরণ এবং খুন। সরকারী পক্ষ থেকে দুই বোনের প্রোফাইলিং করতে আসেন তথ্যচিত্র নির্মাতাদ্বয় – নিখত ইসমাইল (শিবানী রঘুবংশী) এবং গুণদীপ সিং (ইমাদুদ্দিন শাহ)। সাইকোলজিকাল প্রোফাইলিং কি? না, সরকারী উদ্যোগে অপরাধীদের মনঃস্তত্ব বিশ্লেষণ, যাতে ভবিষ্যতে এই মানসিকতা-সম্পন্ন অপরাধীদের সনাক্ত করতে সুবিধা হয়।
তথ্যচিত্র নির্মাতাদের প্রথম সাক্ষাৎকার রেঘার সাথে। রেঘা মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ, বিচলিত। ওনার সাক্ষাৎকারে ফুটে ওঠে ওনাদের মা প্রজক্তা দেশপান্ডের (মাহী গিল) অত্যাচারের কথা। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয়, প্রজক্তা ড্রাগ-অ্যাডিক্ট, এবং নেশার যোগানের জন্যে বিভিন্ন লোকের সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হন, এবং তাদের খুন করে যাবতীয় টাকা-পয়সা-ঘড়ি-আংটি ইত্যাদি চুরি করেন। খিদের তাড়নায় ছোট রেঘা যখন মায়ের কাছে খাবার চাইতে যায়, মা তার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে চাল কিনে আনতে বলেন। সেই ভাত থালায় নিয়ে খেতে বসেছে রেঘা, ওদিকে প্রজক্তা তার শিকারকে খুন করে কুচিকুচি করে কাটছে। সেই রক্ত ছিটকে এসে পড়ল রেঘার খাবার থালায়। রক্তমাখা ভাতটুকু তুলে ফেলে রেঘা আবার মনোনিবেশ করল নিজের খাওয়ায়। প্রবৃত্তি, নাকি প্রতিপালন?
রেঘা তার মায়ের নিয়ন্ত্রক চরিত্রে এতটাই নিমজ্জিত, যে কারাবাসেও সে তার মৃতা মা-কে হ্যালুসিনেট করে। তার মনের গভীর থেকে যেন তার মা আদেশ করে, ঘরের কথা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। রেঘা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে, কারাগারের দেওয়ালে মাথা ঠোকে।
ছোট বোন শিখা অনেক পরিণত চরিত্র। তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ে গুণদীপ অনুপস্থিত। নিখতকে শিখা শোনায় তার করুণ কাহিনী। শিখা প্রজক্তার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। তার বাবা ধর্মেশ দেশপান্ডে (রণধীর রায়) আর্মিতে আছেন। প্রজক্তা ধর্মেশের বাড়িতে কাজ করত, সেই সূত্রে তার সাথে প্রণয় ও পরিণয়। কিন্তু, এক পার্টি চলাকালীন প্রজক্তা কিছু চুরি করে, এবং হাতেনাতে ধরা পরে যায়। সেই ঘটনার পরে ধর্মেশ তাকে এবং দুই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। শিখাকে তুলনামূলকভাবে তার মায়ের হিংস্র স্বভাবের শিকার হতে হয়নি, যতটা তার বড় বোন রেঘাকে হতে হয়েছে। এবং, কিছুটা বাধ্য হয়েই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে শিখা এই অপরাধের জগতে জড়িয়ে গেছে।
শিখার সাক্ষাৎকার নিখতের মনে গভীর বিশ্বাস জাগায়, যে শিখা আদতে নির্দোষ। ফাঁসির মতো ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট তার প্রাপ্য নয়। প্রবৃত্তি নয়, প্রতিপালন।
গুণদীপ প্রথমে নিখতের মতের প্রতিবাদ করে, কিন্তু ক্রমশ সাক্ষাৎকারের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তার মনেও এই ধারণা বাসা বাঁধতে শুরু করে।
নিখত এবং গুণদীপ যখন জানতে পারে যে প্রজক্তার এক মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, এবং শিখার থেকে যখন শোনে যে শিখাই সেই দুর্ভাগী, তখন শিখার প্রতি তাদের সমবেদনা আরো বেড়ে যায়।
গল্পের প্রবাহ এরপর এসে দাঁড়ায় সেই ঘটনায়, যার কারণে তাদের গ্রেফতার হতে হয়। প্রজক্তা জানতে পারে যে ধর্মেশ আবার বিয়ে করেছে, এবং তার এক সন্তানও হয়েছে। হিংস্র স্বভাবের প্রজক্তা ঠিক করে নেয়, ধর্মেশের ছেলেকে মারতে হবে। দুই মেয়েকে নিয়ে সে পৌঁছে যায় ধর্মেশের বাড়ি। সেখানে গিয়ে পুরানো অপরাধের ক্ষমা চেয়ে ধর্মেশের মন জয় করে, এবং সপ্তাহে একদিন সপরিবারে তার বাড়িতে সময় কাটানোর অনুমতি জোগাড় করে।
ধর্মেশের দ্বিতীয় সন্তান, বিনীত, মানসিক প্রতিবন্ধী। সুযোগ বুঝে একদিন প্রজক্তা, রেঘা ও শিখা বিনীতকে অপহরণ করে। তাদের প্রতিবেশীর কোন কারণে সন্দেহ হয়, এবং তিনি পুলিশকে জানান। দুর্ভাগ্যবশতঃ, পুলিশ আসার আগেই বিনীতকে হত্যা করা হয়। কিন্তু, পুলিশ প্রজক্তা, রেঘা ও শিখাকে গ্রেফতার করতে সফল হয়।
তারপর গল্পের মোড় ঘুরে যায়। কিন্তু, সেটা বলে ফেললে আপনারা যারা সিনেমাটা দেখবেন-দেখবেন করছেন, তাঁদের সাসপেন্সটা মাটি হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত প্রবৃত্তি নাকি প্রতিপালন, কে জিতল আর কে হারল, জানতে হলে দেখে নিন নিজেই। তাই গল্পটা এখানেই শেষ করব।
বরং, এই সিনেমাটার টেকনিক্যাল অ্যাঙ্গেল নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক।

সিনেমা মূলত আমরা দেখি এবং শুনি। তাই, যেকোন সিনেমাকে গোদাভাবে তিনটি বিভাগ দিয়ে বিচার করা যায় – ডায়ালগ বা সংলাপ, সিনেম্যাটোগ্রাফি বা চিত্র-সঞ্চালন এবং মিউজিক বা যন্ত্র ও সংগীত অনুসঙ্গ। এবং, অতি অবশ্যই, অভিনয় – যা এই তিনটে বিভাগকে একসাথে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়।
প্রথমে আসি অভিনয়ে। প্রধান চরিত্রে মাহী গিল, সায়নী গুপ্ত ও রাগিনী খান্নার অভিনয় অনবদ্য। বিশেষতঃ, মাহী গিল। ক্রূর অথচ মোহিনী এক চরিত্র, যে একদিকে বিভিন্ন পুরুষকে প্রলোভিত করছে, অপরদিকে বিনা দ্বিধায় এবং বিনা প্ররোচনায় হত্যা করছে – অসম্ভব সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছেন মাহী। মানসিকভাবে অসুস্থ এবং মায়ের বিশাল ছায়াতে আটকে থাকা এক চরিত্রে সায়নীর অভিনয়ও অনবদ্য। তুলনায় রাগিনীকে একটু ফিকে লেগেছে, কিন্তু সেটা অভিনয়-দুর্বলতার জন্যে নাকি চরিত্রের প্রয়োজনে, সেটা বলতে পারব না।
চিত্রগ্রহণ কিছু ক্ষেত্রে কপিবুক-বহির্ভূত, এবং সেই কারণে কিছু শটের ব্যাকরণ ও প্রয়োজনীয়তা আমার বোধগম্য হয়নি। যেমন, সাধারণতঃ কোন চরিত্রের কতৃত্ব বোঝাতে গেলে লো-অ্যাঙ্গেল ব্যবহার প্রত্যাশিত, কিন্তু এখানে অনেক ক্ষেত্রেই মিড-শট ব্যবহার হয়েছে। তাই, দৃশ্যগতভাবে নির্দিষ্ট চরিত্রের কতৃত্ব ফুটে ওঠে নি, সেখানে অভিনয় এবং সংলাপের উপরে নির্ভর করতে হয়েছে।
কিছু শট-সিক্যুয়েন্সিং গল্পের প্রবাহে সামান্য ছেদ টেনেছে। সেই দায় নির্দেশকের নাকি সম্পাদকের, তা জানা নেই।
থ্রিলার-জাতীয় সিনেমায় সাউন্ডের ব্যবহার পরিবেশে টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম। এই সিনেমা সেই বিভাগে অনবদ্য। প্রচন্ড ক্লিশে থ্রিলার মিউজিক নয়, কিন্তু সাসপেন্সটা কখনোই হারিয়ে যায়নি।
এই সিনেমার নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায়, যিনি হারবার্ট-এর জন্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। যেহেতু সিনেমার প্রত্যেকটা বিভাগের জন্যেই নির্দেশক দায়ী, তাই হয়তো পোশাম-পা-এর জন্যে ওনাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিতে পারব না। কিন্তু, এমন গল্প এবং চিত্রনাট্য ভারতীয় সিনেমায় নিয়ে আসার জন্যে অসংখ্য সাধুবাদ ওনার অবশ্য-প্রাপ্য।
সিনেমাটা দেখুন। আশা রাখি আপনাদেরও ভালোই লাগবে। যদিও এক শিশুপাঠ্য ছড়া এই সিনেমার নামকরণের আধার, এই সিনেমা কিন্তু আদতে একদমই শিশুদের জন্যে নয়!