অগ্নিভ সেনগুপ্ত
আজ থেকে ১০-১১ মাস আগে ‘সময়’-এর সাথে আমার যাত্রা শুরু ‘হল্যান্ডের হালহকিকত’ সিরিজের মাধ্যমে। তারপর আমস্টেল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সময়ের এই সিরিজে উনিশটা প্রবন্ধ লেখা হয়ে গেছে। আজকের লেখার সাথে এই সিরিজের প্রবন্ধ-সংখ্যা টিন-এজ পেড়িয়ে কুড়িতে পড়ল। এবং, এই লেখার সাথেই এই সিরিজে আপাতত ইতি টানলাম।
আজকের এই লেখায় তাই, সুকুমারীয় ভাষায়, “লিখব যা মোর চিত্তে লাগে”, আর ম্যানেজমেন্টের ভাষায়, ‘wrapping it up’।
নেদারল্যান্ডসে, তথা ইয়োরোপে আপনার আসার কথাবার্তা শুরু হলেই আত্মীয়পরিজন-বন্ধুবান্ধব মহলে আপনার সম্ভাব্য উপার্জন নিয়ে জল্পনা বেশ গম্ভীর রূপ ধারণ করে। আপনিও মনে-মনে পঁচাত্তর বা আশির নামতা মুখস্থ করতে থাকেন। বিশেষতঃ, আপনার গন্তব্য নেদারল্যান্ডস হলে আপনার বন্ধুরা বেশ বাঁকা হাসি আপনার দিকে ছুঁড়ে মারে। একদিকে ইউরোর কনভার্সন রেটের আনন্দ, অন্যদিকে লিগালাইজড সফ্ট ড্রাগস ও রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টের নিষিদ্ধ হাতছানির উত্তেজনা বুকে নিয়ে আপনি প্লেনে চড়ে বসেন।
প্রথমেই আপনার আশায় জল ঢালবে, হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই, নেদারল্যান্ডসের আবহাওয়া। এখানে আবহাওয়ায় হাওয়া এবং বৃষ্টির প্রভাব বেশ প্রবল, সমুদ্র-তীরবর্তী দেশ হওয়ার কারণেই হয়তো। স্যাঁৎস্যাঁতে এবং সূর্যালোকের অভাবের কারণে এখানে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট প্রত্যেকের, বিশেষতঃ শিশুদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে উপদিষ্ট। কয়েক সপ্তাহের গ্রীষ্ম এই দেশে উৎসবের সমতুল্য। ছোটদের প্রায় দু-মাস স্কুলে ছুটি, বড়রাও অফিসে ছুটি নিয়ে ছুট লাগান কয়েকদিনের জ্যাকেট-বিহীন জীবনকে উপভোগ করতে।

গ্রীষ্মকালেই এই অবস্থা, শীতকালের কথা নাহয় নাই বা লিখলাম। শীতের সময়ে দিন ছোট এবং রাত বড় হয়, ভূগোলে পড়েছিলাম, আর এখানে এসে উপলব্ধি করলাম হাড়ে-হাড়ে। সকালে অফিসে বেড়িয়েছি, অন্ধকার। বিকালে বাড়ি ফিরছি, তখনও অন্ধকার। মাঝখানে সূয্যিমামা কখন টুকি বলে চলে গেছেন, টেরও পাইনি।
নেদারল্যান্ডসে যাঁরা ঘুরতে আসতে চান, তাঁদের জন্যে আদর্শ সময় হচ্ছে এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। বিশেষতঃ, এপ্রিল এবং মে মাসে এলে এখানকার বিখ্যাত টিউলিপের শোভা উপভোগ করতে পারবেন।
উপরি পাওনা, এপ্রিলের ২৭ তারিখ এখানে উদযাপিত হয় ‘কিংস ডে’। রাজার জন্মদিন উপলক্ষে একদিন যা-খুশি-তাই করার দিন। সেই দিনে গোটা নেদারল্যান্ডস এক খোলা বাজারের রূপ ধারণ করে, পুরো দেশ সেজে ওঠে তাদের রাজকীয় রঙ কমলায়। – সে এক দেখার মতো উৎসব।
এমনিতে নেদারল্যান্ডস শান্ত দেশ, আমাদের মতো বারো মাসে তেরো পার্ব্বণ এদের নেই। উৎসব-আনন্দও বেশ সংযত, ব্যতিক্রম ফুটবল এবং কিংস ডে। এই দুই ক্ষেত্রে ডাচদের নিয়মানুবর্তীতা শিকেয় ওঠে।

সাধারণভাবে ডাচরা খুব নিয়মানুবর্তী জাত। কিছুক্ষেত্রে এদের জীবনযাত্রা বেশ যান্ত্রিক বলেই মনে হয়। যেমন আগেও লিখেছিলাম, এদের জীবন ক্যালেন্ডার মেনে চলে। দিনের প্রত্যেকটা কর্মসূচী – বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সময়, সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়, এমনকি অনেকক্ষেত্রে ফল খাওয়ার সময়ও এদের অ্যাজেন্ডা-মাফিক চলে। সেই ক্যালেন্ডারের একটু এদিক-ওদিক হলে এরা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান। সুতরাং, আপনার প্রতিবেশী বা অফিসের সহকর্মীর বাড়িতে হঠাৎ করে যদি আপনি “মালপো খামু” বলে হাজির হন, খুব-একটা আতিথেয়তা আশা করবেন না।
পক্ষান্তরে, বেশ অপমানজনক কিছু কথা শুনলেও আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। ডাচেদের স্পষ্টবাদী হিসাবে বেশ দুর্নাম আছে। এবং, কিছু ক্ষেত্রে সেই স্পষ্টবাদীতা বেশ অপমানজনক হয়ে ওঠে।
যাক, যে কথা বলছিলাম। আপনার বোহেমিয়ান জীবনের স্বপ্নে প্রথমেই জল ঢেলেছে আবহাওয়া। তারপরের নেমেসিসের নাম – বেলাসতিঙদিয়েনস্ত। না না, কোন ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, ডাচ আয়কর বিভাগ।
ইয়োরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতোই নেদারল্যান্ডসেও উচ্চ আয়কর। এবং, এখানে এল-আই-সি, পি-পি-এফের সেভিংস দেখিয়ে আয়কর বাঁচানোর কোন বিধান নেই। সুতরাং, আপনাকে আপনার আয় অনুপাতে ৩৬% থেকে ৫২% অবধি আয়কর দিতে হতে পারে।
তা ছাড়া, নেদারল্যান্ডসে দৈনন্দিন ব্যয় খুব-একটা কম নয়। ১২০০-১৫০০ ইউরোর কমে বাড়িভাড়া পাওয়া দুষ্কর, খাওয়াদাওয়াও বেশ ব্যয়বহুল। অর্থাৎ, আপনি যদি মধ্যবিত্ত পারিবারিক মানুষ হন, আপনার বোহেমিয়ান জীবনের স্বপ্নকে এক কাপ চায়ের সাথে ঢক করে গিলে ফেলুন।

খাওয়াদাওয়ার কথা যখন উঠলোই, তখন সেই নিয়ে দু-চার কথা না বললেই নয়। ইতিহাস বলে, ডাচেরা নাকি মশলার সন্ধানে ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। কিন্তু, সেই মশলা যে এদের কোন কাজে লেগেছে, তা আমি এখনো আবিষ্কার করতে পারলাম না। এখানে দৈনন্দিন খাদ্য বিভিন্ন প্রকারের পাঁউরুটি, এক-দু টুকরো চীজ, সাথে পাতলা সেদ্ধ করা মাংসের টুকরো, অথবা সসেজ। দুধ বা দুধজাতীয় খাদ্যও এখানে বেশ জনপ্রিয়। আমাদের মতো চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-সম্পৃক্ত গুরুভোজন এখানকার রীতি নয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ডাচেরা শুকনো ঠান্ডা খাবার খেতেই বেশী অভ্যস্ত। এই সিরিজেই একটা লেখায় খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বিষদে আলোচনা করেছিলাম, পড়ে দেখতে পারেন।
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, অর্থনৈতিকভাবে যখন খুব-একটা লাভবান আপনি হচ্ছেন না, কিংবা ঠান্ডায় কাঁপতে-কাঁপতে কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন, যেখানে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়ার বিলাসিতাটুকুও নেই, তাহলে মশাই আপনি এখানে এতো বছর কাটালেন কেন? আমার চশমার কাঁচ মাইনাস সাড়ে-সাত, দূরের জিনিস কম দেখি। তাই, আমার মধ্যে দূরদর্শী প্ল্যানিঙের অভাব প্রকট। আমার কাছে, টেক লাইফ অ্যাজ ইট কামস।
কিন্তু, আমার অনেক দূরদর্শী বন্ধু আছেন যাঁরা নেদারল্যান্ডসে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়ে নিয়েছেন, এবং নিজেদের জীবনটাও সেইভাবেই সাজিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের বেশীরভাগের এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান যুক্তি – লিভিং কমফর্ট।
হ্যাঁ, এখানকার রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়না, ট্রেন-ট্রাম-বাস সময়মতো চলে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সরকার-দ্বারা পরিচালিত, এবং প্রায় বিনামূল্যেই সকলের জন্যে সহজলভ্য। যদিও এখন চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা কিছু-কিছু খবরে আসছে, কিন্তু বিরল। নিরাপদ পরিবেশ, মাঝরাত্রেও আপনি নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন।
তবে, আমার যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লাগে, তা হচ্ছে – ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স। আপনার যত্নের সাথে লালিত ইচ্ছা, যা হয়তো দিনে বারো-চোদ্দ ঘন্টা ঘানি টেনে আপনি পূরণ করতে পারতেন না, অনায়াসে নেদারল্যান্ডসের কর্মসংস্কৃতিতে আপনি তা করতে পারেন। যেমন আগের প্রবন্ধেও লিখেছিলাম, এখানে জীবিকা জীবনধারণের একটা অঙ্গমাত্র, প্রধান উপকরণ নয়। আপনার জীবনের প্রথম এবং প্রধান উপকরণ আপনার পরিবার, আপনার ছোট-ছোট ইচ্ছা, সামান্য ভালোবাসা।
অফিস থেকে ফিরে বাড়ির সামনের ছোট বাগানটার অথবা আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামটার পরিচর্যা করুন। আপনার সন্তানের ড্রয়িং খাতাটা খুলে বসুন। ছবি তুলুন, কবিতা লিখুন, নাটক করুন – এবং আপনার দৈনন্দিন জীবিকা বজায় রেখেই। ও হ্যাঁ, একটু সময় নিয়ে এই লেখাটাও পড়ুন, এবং আপনার মূল্যবান মতামত জানান।
হল্যান্ডে হালহকিকত সিরিজকে আপাতত বিদায় জানালাম। সময়ের সাথে সময়-এর পাতায় লিখতে থাকব, তবে অন্যান্য বিষয় নিয়ে। তখন দেখা হবে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন ভাবনার সাথে। ভালো থাকবেন।