গৌরব বিশ্বাস
যে সময়কার কথা বলছি, সেসময় হাতে মোবাইল ওঠেনি। এদেশে কম্পিউটার এলেও মধ্যবিত্ত বাঙালী সেসব দেখেনি তখনও। কালার টিভি ছিল গুটিকয়েক মধ্যবিত্ত ঘরে। ছাদের এন্টেনায় কাক বসলে টিভির ছবি চলে যেত বেমালুম। ডি ভিডি প্লেয়ারের চল হয়নি। ছিল ভি সি আর সাথে থান ইঁটের মতো জাবদা ক্যাসেট। সেই নব্বইয়ের দশক। সে যুগ এযুগের মিসিং লিংক। সেই নব্বইয়ের দশকেই আমার বাবা এক টেপ রেকর্ডার কিনেছিল আমার জন্মের মাস কয়েক পরেই। আমাদের বাড়ির প্রথম ইলেকট্রনিক গ্যাজেট। বসার ঘরের টেবিলের উপর রাখা থাকত টেপরেকর্ডারটা। ফিলিপসের। কোনো আড়ম্বর নেই । ক্যাসেটের ফিতা ঘুরতে ন্যুনতম যেসব কলকব্জা প্রয়োজন সেটুকুই। কাঁধের উপর একঝাঁক বোতাম। একটা বোতাম টিপলে ক্যাসেট ভরার খাপ টুক করে খুলে আসে। ক্যাসেট ভরে খাপ বন্ধ করে প্লে বোতাম টিপে দিলেই গান শুরু। এক পিঠের গান শেষ হলে খাপ খুলে ক্যাসেট বার করে ক্যাসেট উল্টে দিলেই হল। টেপরেকর্ডারের সাথে রেডিওও ছিল। তখনও এফ এম আসেনি। আকাশবাণী কোলকাতা আর দিল্লির কিছু চ্যানেল ধরত।
একবার সরস্বতী পুজোর দিন বাবা একটা ক্যাসেট কিনে আনল। ক্যাসেটের নাম বাবুরাম সাপুড়ে। উপরের ছবিটা এখনও মনে আছে। রঙিন ছবি। একটা সাপুড়ে রঙবেরঙের পাগড়ি পরে বীন বাজাচ্ছে। একটা সাপ তার তালে তালে ঝাঁপি খুলে মাথা দোলাচ্ছে। এইচ এম ভি এর ক্যাসেট। এ পিঠ ও পিঠ মিলিয়ে গোটা আটেক গান আছে। সব গান গেয়েছেন সনৎ সিংহ। দুটো সুকুমার রায়ের কবিতা । ও দুটোকে গানের সুর দেওয়া হয়েছে। বাবুরাম সাপুড়ে আর এই দুনিয়ায় সকলই ভালো। বাকি গান গুলো কার লেখা ঠিক জানা নেই। কিছু গান খুব মনে পড়ে। একটা গান ছিল-” কে আমারে বলতে পারে রঙ মশালের মশলা কি”। আরেকটা গান সেসময় গুন গুন করে গাইতাম। এই ক্যাসেটেরই গান কয়েকটা লাইন বেশ মনে আছে-” এক এক্কে এক দুই একে দুই/নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে/নন্দী বাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে/ মন বসে কি আর/ আহা হা চন্ডী তলায় বাদ্যি বাজে ঢাক গুরু গুর/ তাক তা ধিনা তাক তা ধিনা তাক কুরু কুর / কুরুর কুরুর তাক”। আরও কয়েকটা গান মনে পড়ে। “রথের মেলা রথের মেলা বসেছে রথতলায়/আর ওর দুপুরে রথতলাতে ছেলেরা ভীড় জমায়/ পাতার বাঁশির পাঁপড় ভাজার হাজার হুড়োহুড়ি/ওই মেঘ গুড়গুড় আকাশ করে আলোর লুকোচুরি”। সম্ভবত এই গানটা অনল চট্টোপাধ্যাভয়ের লেখা। ওই গানটা-” তাকদুম তাকদুম দুমা দুম ঢোলক বাজে/ বাজে রে তাক দুমাদুম তাক দুমাদুম বাজনা”। তবে যে গানটার জন্যে কেনা ক্যাসেটটা, সেটা ছিল একদম শেষ গান। পুরো গানটাই দিলাম-“
সরস্বতী বিদ্যেবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি
একটু দয়া করো মাগো, বুদ্ধি যেন হয়।
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়।।
শুনলে তোমার দুঃখু হবে মাগো —
কোন্ দেশেতে ধান বেশি হয়, কোন্ দেশেতে গম!
মনে আমার থাকে না যে, কোথায় হনলুলু!
ভূগোল দেখে তাই মনে হয়, বুক ঢিব্-ঢিব্ জল।
দোষ বল কার পরীক্ষাতে, যদি করি ভয়!
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়।।
সত্যি করে বলছি তোমায় মাগো —
গুরুমশাই যখন-তখন কানটা ধরেন এসে!
বলেন, পাজি হাডু-ডুডু, কেবল খেলা, খেলা?
অঙ্ক-ভূগোল-ইংরাজীতে গোল্লা খাবি শেষে।।
শুনলে তোমার দুঃখু হবে মাগো —
অঙ্ক মাথায় ঢোকেনা যে নতুন ধারাপাত
কিলো-মিলি-হেক্টা-ডেকার ঢাক্কা খেয়ে শেষে,
লিটার-মিটার-গ্রাম নিয়ে সব ধূলোয় কুপোকাৎ!
ছোট্ট মাথায় কত ধরে তাই তো লাগে ভয়!
এসব কথা লিখছি তোমায় নালিশ করে নয়।।
টেপরেকর্ডারটা এখন আর বাজানো হয়না। সে এখন বৃদ্ধ। চলতে গেলে বুকে জমা কফ ঘর ঘর করে ওঠে। কোম্পানিতে নিয়ে গিয়েছিলাম সরানোর জন্যে। তারাও জবাব দিয়েছে।ওটা এখনও বাইরের টেবিলে সাজানো থাকে। আজ সকালে এসব গান গুলো বড় মনে পড়ছিল। ইউটিউব চালিয়ে শুনলাম। টেপরেকর্ডার বা ইউটিউব যেখান থেকেই শুনি, মেজাজটাই আসল তাই না!