অগ্নিভ সেনগুপ্ত
সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে জে-এন-ইউতে হোস্টেল ফী এবং অন্যান্য বেতনবৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্ররা ধর্ণায় নেমেছিল, সেই খবর নিশ্চয়ই বিভিন্ন মাধ্যমে আপনাদের কাছে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এই ছাত্র আন্দোলনকে সরাসরি ভারত-বিরোধী বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় জে-এন-ইউয়ের দেশদ্রোহীরা প্রায় বিনামূল্যে হোস্টেলে থাকবে-খাবে, সেই আবদার আর চলবে না। অনেকেই দাবী করছেন, আই-আই-টি বা আই-আই-এমের মতো প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা তো অনেক বেশী বেতন দেয়, তারা তো এইসব প্রতিবাদ ইত্যাদি করে না! সত্যি কথা, কিন্তু বড় লজ্জার কথা।
একটু কষ্ট করে এই পরিসংখ্যানটা একটু পড়ে ফেলুন। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষের জি-ডি-পির ২.৭% খরচ হয় শিক্ষা খাতে। আর উচ্চশিক্ষায় মাত্র ০.৬৯%, মানে ১%-এরও কম। মানে, যদি ধরে নেওয়া যায় যে ২০১৯ সালেও বরাদ্দ একই আছে, উচ্চশিক্ষা খাতে অনুদান বছরে ১৮ মিলিয়ন ডলার মাত্র। আপনার বহু আকাঙ্খিত স্ট্যাচু অফ ইউনিটি বানাতে খরচ হয়েছে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১৮ বছরের উচ্চশিক্ষার বাজেট। আর, শিবাজী স্ট্যাচু বানাতে খরচ হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২২ বছরের উচ্চশিক্ষা বাজেট। এবং, সেই খরচও আপনার কষ্টার্জিত ট্যাক্সের পয়সা থেকেই এসেছে।
সেই তুলনায় অন্যান্য দেশের শিক্ষা-বাজেটে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। নেদারল্যান্ডসের মতো প্রথম বিশ্বের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা তো বিশদে লেখার জন্যেই তো এই ভূমিকার অবতারণা, কিন্তু তার আগে আফ্রিকার কিছু দেশের জি-ডি-পি অনুপাতে শিক্ষা-বরাদ্দের একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। আলজিরিয়া তার জি-ডি-পির ৪.৩% ব্যয় করে শিক্ষাখাতে, বতসোয়ানা ৯.৬%, ক্যামেরুন ৩.১%, কোস্টা রিকা ৭.৪%, এস্টোনিয়া ৫.২%, ঘানা ৩.৬%, কেনিয়া ৫.২%, নাইজেরিয়া ৩.১%, সেনেগাল ৪.৮%, তানজানিয়া ৩.৪%।
আর আমাদের পড়শী দেশগুলি? নেপাল ৫.২%, ভুটান ৬.৬%, আফগানিস্তান ৪.১%, মায় পাকিস্তান, যাকে নিয়ে হাসাহাসি না করলে আমাদের ভাত হজম হয় না, তারও ২.৯%।
সেটাই তো স্বাভাবিক। দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজি, যা ভবিষ্যতের দক্ষ প্রশাসক, বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক, সম্মানীয় ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারদের আঁতুড়ঘর, সেখানেই তো বিনিয়োগ করা বিচক্ষণতার লক্ষণ।
ইদানীং ভারতবর্ষে ইতিহাস-চর্চার আগ্রহ প্রবল। সেই সূত্রে কখনো যদি নালন্দা বা তক্ষশীলার ইতিহাস ঘাঁটেন, তাহলে দেখতে পাবেন, আদিমকাল থেকেই ভারতবর্ষে শিক্ষাব্যবস্থার ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন তৎকালীন রাজা এবং ধনবান ব্যক্তিরা। গুরুকুল হোক বা মহাবিদ্যালয়, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হতো না। ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ, আর যাতে সেই অধ্যয়নের মাঝে তাদের থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা না করতে হয়, সেইদিকে কড়া নজর থাকত তৎকালীন শাসকদের। যাক, সেই ইতিহাস আমাদের কাছে খুব-একটা ইন্টারেস্টিং নয়, কারণ সেই ইতিহাস মশলা মাখিয়ে পরিবেশন করা দুষ্কর।
বরং, বর্তমানে ফিরে আসা যাক, একটু আলোচনা করা যাক নেদারল্যান্ডসের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। অন্যান্য প্রথম বিশ্বের দেশের মতো নেদারল্যান্ডসেও রাইট টু এডুকেশনের গুরুত্ব প্রবল। ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ছাড়া বাকি সব স্কুলই সরকারী। প্রাথমিক শিক্ষা সরকার থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয় সমস্ত সরকারী স্কুলে, এবং সেই শিক্ষা আন্তর্জাতিক মানের। আর, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ? যে পার্টির সরকারই আসুক না কেন, জি-ডি-পির ৫.৫% – ৬% বরাদ্দ হয় শিক্ষাখাতে।

পাঁচ বছর বয়স থেকে এখানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক। স্থানীয় পৌরসভা থেকে প্রত্যেক অভিভাবককে সেই মর্মে চিঠি পাঠানো হয়, এবং সন্তানের বয়স পাঁচ বছর হয়ে গেলে স্কুলের সাক্ষরসহ চিঠি জমা করতে হয়। যদি আপনি স্কুলে ভর্তি করতে অসমর্থ হন, তাহলে সরকার থেকে যথাযথ স্কুল খুঁজতে সাহায্যও করা হয়। নেদারল্যান্ডসে শিক্ষার সার্বিক অধিকার সম্বন্ধে সরকার এতোটাই সচেতন, যে আপনি যদি স্কুল চলাকালীন ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরতে যান, তাহলে আপনি অভিবাসন দপ্তরের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন। স্কুল থেকে আপনার ছুটি অনুমোদিত হয়ে থাকলে অসুবিধা নেই, কিন্তু অন্যথায় আপনাকে বেশ মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হতে পারে।
নেদারল্যান্ডসে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যপ্তি সাত বছরের, পাঁচ বছর বয়স থেকে বারো বছর বয়স অবধি। শিক্ষার্থীর বয়স বারো হলে একটি বিশেষ পরীক্ষায় বসতে হয় মাধ্যমিক শিক্ষালাভের জন্যে। বেশীরভাগ স্কুলেই প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হতে গেলে সিটো টেস্টে বসতে হয়।
এই সিটো টেস্টের ফলের উপরে নির্ভর করে ছাত্রের মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম। নেদারল্যান্ডসে মাধ্যমিক শিক্ষা মূলতঃ তিন ভাগে বিভক্ত:
প্রথম, VMBO বা Voorbereidend Middelbaar Beroepsonderwijs, যেখানে প্রধানতঃ তত্ত্বশিক্ষার পাশাপাশি হাতেকলমে কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তত্ত্বশিক্ষা ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার অনুপাতে আবার -কে চারটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। কোন ছাত্রের প্রশিক্ষণের বিভাগ নির্ভর করে তার প্রাপ্ত ফলের উপরে। সেই চারটি ভাগ যথাক্রমে:
ক. Theoretische leerweg (VMBO-TL), এখানে শুধুমাত্র তত্ত্বশিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়।
খ. Gemengde leerweg (VMBO-GL), এখানে তত্ত্বশিক্ষাই মূল, কিন্তু হাতেকলমে প্রযুক্তিশিক্ষাও দেওয়া হয়।
গ. Kaderberoepsgerichte Leerweg (VMBO-KL), এখানে পাঠ্যক্রমের অর্ধেক তত্ত্বশিক্ষা এবং অর্ধেক প্রযুক্তিশিক্ষা।
ঘ. Basisberoepsgerichte Leerweg (VMBO-BB), এখানে শুধুমাত্র প্রযুক্তিশিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়।
VMBO-এর সময়কাল চার বছরের।
VMBO-তে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার আবেদন করার জন্যে MBO বা Middelbaar Beroepsonderwijs ডিগ্রী আবশ্যক। -এর সময়কাল চার বছর, এবং সেখানে মূলতঃ প্রযুক্তি ও তত্ত্বশিক্ষা উচ্চস্তরে দেওয়া হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বিতীয় বিভাগ, HAVO বা Hoger algemeen voortgezet onderwijs। এই বিভাগের সময়কাল পাঁচ বছরের। এখানেও প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং তত্ত্বগত শিক্ষার মেলবন্ধন করা হয়, কিন্তু -এর থেকে একটু উচ্চস্তরে। HAVO-তে তৃতীয় বছরে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিশেষ বিভাগে শিক্ষালাভ করতে পারে।
মাধ্যমিক স্তরে তৃতীয় বিভাগ, VWO বা Voorbereidend wetenschappelijk onderwijs। এর মেয়াদকাল ছয় বছর, এবং এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সরাসরি উচ্চশিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারে। এখানে প্রযুক্তিশিক্ষা ও তত্ত্বশিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদিও শেখানো হয়। HAVO-র মতো VWO-তেও তৃতীয় বছরে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিশেষ বিভাগে শিক্ষালাভ করতে পারে।
নেদারল্যান্ডসে উচ্চশিক্ষায় মূলতঃ দুটি বিভাগ। প্রথম, HBO, যেখানে প্রধানতঃ প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে MBO, HAVO এবং VWO স্নাতকরা আবেদন করতে পারেন। দ্বিতীয়, WO, যেটি মূলতঃ অধ্যয়ন-বিষয়ক। সেখানে শুধুমাত্র HAVO এবং VWO স্নাতকরা আবেদন করতে পারেন।

আপনাদের নিশ্চয়ই এই শ্রেণীবিন্যাস পড়তে-পড়তে বিভ্রান্ত লাগছে। বেশ জটিল ব্যবস্থা, নিঃসন্দেহে। নেদারল্যান্ডস সরকার প্রতিবছর প্রায় তিন লক্ষ ছাত্রের এই জটিল শিক্ষাব্যবস্থার ভারবহন করে চলেছে, এবং বিনামূল্যে। আর, শিক্ষার মান? PISA বা Programme for International Student Assessment-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এখানে ৯৫% মানুষ সাক্ষর, অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডী উত্তীর্ণ করেছে।
নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী রাষ্ট্র জার্মানির কথা তো ছেড়েই দিলাম। যে দেশে আইনস্টাইন-হাইজেনবার্গ-প্ল্যাঙ্কের মতো পদার্থবিদ, অটো হান বা ফিসারের মতো রাসায়নিক, গাউস বা ডেভিড হিলবার্টের মতো গণিতজ্ঞ অথবা নিৎসে-মার্ক্সের মতো চিন্তাবিদরা শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, যে দেশ থেকে ১০৮ জন নোবেল পেয়েছেন, সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু লেখার মতো ভাষা আমার নেই। তবে, আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, জার্মানিতেও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা এবং ব্যয়ভারবহন সরকারী দায়িত্ব। তাই, আপনাদের অনুরোধ, দেশের ছাত্রেরা যদি মূল্যবৃদ্ধির দাবীতে পথে নামে, সেই প্রতিবাদকে দেশদ্রোহের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। আই-আই-টি, আই-আই-এম বা জে-এন-ইউয়ের মতো উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি অর্থের অভাবে মেধাবী ছাত্রেরা ভর্তি না হতে পারে, অথবা বর্ধিত খরচের কারণে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন, তাতে আখেরে দেশেরই ক্ষতি। দ্বেষপ্রেম ছাড়ুন, দেশপ্রেম করুন। ভালো থাকবেন, পড়তে থাকবেন, আর আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।