অগ্নিভ সেনগুপ্ত
‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটা আশা করি সকলেই দেখেছেন। মনে পড়ে সেই দৃশ্যটা, যেখানে মগজধোলাইয়ের ঘরে ঢোকানো হয়েছে হীরকরাজা-সহ তাঁর পারিষদদের, এবং উদয়ন পন্ডিত মগজধোলাইয়ের মন্ত্র দিচ্ছেন, “অনাচার করো যদি, রাজা তবে ছাড়ো গদি। যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারী।”
তারপর একদম শেষ দৃশ্যে সকল দেশবাসী প্রজারা মিলে রাজার বিশাল মূর্তি টেনে ফেলে দিচ্ছে, “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।” আর, সেই দড়ি টানার লাইনে এক-এক করে যোগ দিচ্ছেন হীরকরাজা-সহ সকল পারিষদরা, মুখে একই মন্ত্র, “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।”
বাংলা শিশু-চলচ্চিত্রের জগতে আইকনিক এই সিনেমা। কিন্তু, যেমন এখন আপনারা অনেকেই জানেন, ভারতবর্ষে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আরোপিত ইমার্জেন্সীর বিরোধীতার উদ্দেশ্যেই তৈরী হয়েছিল এই চলচ্চিত্র, শিশু-চলচ্চিত্রের মোড়কে। শুধু ইমার্জেন্সি নয়, যুগে-যুগে রাজা বা সরকারের দ্বারা অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের অন্যতম প্রতিফলন – ‘হীরক রাজার দেশে’।
আজকের সারা বিশ্বব্যাপী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রেক্ষিতেও কি রাজার অনাচার এবং রাজধর্ম পালনে অক্ষমতা, অবহেলিত কৃষক-শ্রমিকদের চোখের জল, স্পষ্টবাদীদের শাস্তিপ্রদান (লক্ষণীয়, “কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” গানটি), অথবা “ওরা যত বেশী পড়ে, তত বেশী জানে, তত কম মানে” – মেলানো খুব কষ্ট-কল্পনা কি?
সত্যজিৎ রায় আজকের দিনে এই সিনেমাটা বানালে হয়তো সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রই পেতেন না। আর, পেলেও তার সাথে অ্যান্টি-ন্যাশনাল তকমা এবং প্রতিবেশী দেশের টিকিটও পেয়ে যেতেন।
একটা অপ্রাসঙ্গিক মজার গল্প মনে পড়ছে। একজন যুবক হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে, “দেশের প্রধানমন্ত্রী চোর”। তাকে যথারীতি পুলিশে ধরেছে। যুবক যুক্তি দিল, “কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী চোর, সেটা তো লিখি নি। তাহলে আমাকে ধরা হচ্ছে কেন?” তাতে পুলিশকর্মীর তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আমাকে বোকা পেয়েছ? কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী চোর তা কি আমি জানিনা ভেবেছ?”
যাক, প্রসঙ্গে ফিরি। শিশু-শিল্পের মোড়কে গভীর ভাবতত্ত্ব, তৎকালীন ইতিহাস বা সমাজের প্রতিফলন, অথবা শাষকশ্রেণীর অত্যাচারের বিরূদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ নতুন নয়। পৃথিবীর সব ভাষায় সব সাহিত্যেই এইরকম উদাহরণ ভুরি-ভুরি পাওয়া যায়। তবে আজকের আলোচনায় একটু জুম-ইন করব ইংরাজী নার্সারী রাইমসের জগতে।
বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকলে অবধারিতভাবেই সমস্ত নার্সারী রাইমসের সাথে আপনার পরিচয় বেশ ঘনিষ্ট। একবার এক সান্ধ্যকালীন আড্ডায় অন্তাক্ষ্য়রী খেলার প্রস্তাবে আমার এক বন্ধু বলেছিল, “আমার এখন নার্সারী রাইমস ছাড়া আর কিছু মাথায় আসবে না।” অসংখ্যবার শুনে-শুনে কথা-সুর একদম কন্ঠস্থ! কিন্তু, এই নার্সারী রাইমসের মূল্য কি শুধুমাত্র শিশুদের মনোরঞ্জন? নাকি, এই আপাত-শিশুসুলভ পদ্য তৎকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ব্যক্ত করে? আসুন, একটু দেখে নেওয়া যাক।
১৩৪৭ খ্রীষ্টাব্দ। ইয়োরোপে হানা দিল এমন এক শত্রু, যা এই মহাদেশের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন করে দিল। শত্রুর নাম – বিউবনিক প্লেগ। এই মারণ রোগের প্রাথমিক উপসর্গ, প্রচন্ড জ্বর এবং লসিকাগ্রন্থিতে যন্ত্রণা। বাহ্যিক উপসর্গ রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোস্কার মতো গোলাপী হয়ে ফুলে ওঠা, আর সেই ফোলার চারপাশে চাকার মতো দাগ। অর্থাৎ, Ring around the rosy। বিউবনিক প্লেগের রোগীদের শরীরের ফুলে-ওঠা জায়গায় পুঁজ জমে দুর্গন্ধ বেড়োত। মধ্যযুগীয় ইয়োরোপিয়ানরা সেই দুর্গন্ধ দূর করতে প্লেগ-আক্রান্ত রোগীদের পোষাকে গুঁজে দিতেন সুবাসিত পোজি ফুল। Pocket full of posy। কিন্তু, প্লেগ হলে বাঁচার কোন উপায় সেই যুগে ছিল না। মৃত্যু অবধারিত। Ashes, ashes, we all fall down। শৈশবে আপনি ‘রিং অ্যারাউন্ড দ্য রোজি’ গাইতে-গাইতে বন্ধুদের হাত ধরে খেলা করতেন, আসলে তা সেই ব্ল্যাক ডেথের বিবৃতিমাত্র।

জাম্প-কাট: ফ্রান্স, ১৭৯৩। ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশনের আগুন জ্বলছে। প্রজাদের হাতে বন্দী হয়েছেন তৎকালীন ফ্রেঞ্চ সম্রাট ষোড়শ লুই, এবং তাঁর পত্নী, মেরী অ্যান্টিয়োনেট। অত্যাচারী সম্রাটকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করল ফ্রেঞ্চরা। ২১শে জানুয়ারী ১৭৯৩, ডঃ জোসেফ গিলোটিনের আবিষ্কৃত যন্ত্রে মুন্ডচ্ছেদ করা হলো সম্রাটের, জনসমক্ষে। তার দশ মাস পরে, ১৬ই অক্টোবর ১৭৯৩, সেই গিলোটিনেই শিরচ্ছেদ করা হলো সম্রাজ্ঞী মেরী অ্যান্টিয়োনেটের।
Jack (সম্রাট ষোড়শ লুই) and Jill (মেরী অ্যান্টিয়োনেট), went up the hill,
To fetch a pail of water.
Jack fell down, and broke his crown (সম্রাটের শিরচ্ছেদ), and Jill came tumbling after (দশ মাস পরে সম্রাজ্ঞীর শিরচ্ছেদ)।

আর এক মেরীর গল্প বলা যাক। মেরী টিউডর। প্রটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্মের প্রবর্তন করার নির্মম প্রয়াস করেছিলেন এই সম্রাজ্ঞী। সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের নায়িকাকে ইতিহাস তাই ব্লাডি মেরী নামে অভিহিত করে।
তিন প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক মেরীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওনার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। অবশ্যই, রাণী তাঁদের সেই ষড়যন্ত্রের সংবাদ পেয়ে যান, এবং সেই তিন ধর্মযাজক ধরা পড়ে যান। অকথ্য অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। ইতিহাস বলে, জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার আগে সেই তিনজনের চোখ উপড়ে নেন করে দেন রাণী মেরী।
Three Blind Mice নার্সারী রাইমের আড়ালে নাকি সেই তিন প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজকের গল্পই বলা হয়েছে।
ব্লাডি মেরীর অত্যাচারের ইতিহাস অঙ্কিত হয়েছে আর-এক নার্সারী রাইমে।
Mary, Mary, quite contrary, how does your garden grow?
With silver bells, and cockle shells, and pretty maids all in a row.
অর্থাৎ, মেরীকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, ওনার সাম্রাজ্য বিস্তার কি ভাবে হলো? (how does your garden grow?)
বিভিন্ন নির্মম অত্যাচারের যন্ত্র (silver bells, and cockle shells) এবং শবদেহের (pretty maids all in a row) উপরে তৈরী হয়েছে ওনার সাম্রাজ্য।

আবার, মেরী টিউডরের বাবা, সম্রাট অষ্টম হেনরী ছিলেন প্রটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী, এবং ইংলিশ ভাষাপ্রেমী। ওনার রাজত্বকালে ইংরাজী ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলা, এমনকি প্রার্থনা করাও নিষিদ্ধ ছিল। ক্যাথলিকদের প্রার্থনার ভাষা ছিল ল্যাটিন, এবং সেই কারণেই তাদের প্রার্থনা তৎকালীন ইংল্যান্ডে আইন-বহির্ভূত ছিল। ক্যাথলিকরা লুকিয়ে তাঁদের প্রার্থনাসভার আয়োজন করতেন, এবং ধরা পড়লে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতেন। সেই ইতিহাসই নাকি অঙ্কিত হয়েছিল তৎকালীন এক নার্সারী রাইমে।
Goosey goosey gander, where shall I wander,
Upstairs and downstairs, and in my lady’s chamber.
There I met an old man, who wouldn’t say his prayers,
So I took him down the left leg, and threw him down the stairs.

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে শিশু-সাহিত্য, কিন্তু পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ছায়া – এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে। যেমন, ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’ নাকি ইংলিশ গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত এক কামানের গল্প, কিংবা ‘পিটার পিটার পাম্পকিন ইটার’ নাকি আসলে এক নৃশংস খুনির গল্প যে তার স্ত্রীকে হত্যা করে এক কুমড়োর খোলে লুকিয়ে রেখেছিল।
কিন্তু, এই সবই তো শুধু তৎকালীন ইতিহাসকে হুবহু তুলে ধরার কাহিনী। প্রতিবাদের স্বর কি তাহলে নার্সারী রাইমের স্রষ্টারা চেপে রেখেছিলেন? না, তার উদাহরণও আছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দী, ইংল্যান্ড। রাজকরের চাপে প্রজারা অতিষ্ট। সেই সময়কার এক নার্সারী রাইমে উঠে এসেছে প্রজাদের কষ্টের কথা। যদিও পরবর্তীকালে এই পদ্যের শেষ লাইনটা পাল্টে দেওয়া হয়েছিল, আমি আসল পদ্যটাই তুলে ধরছি।
Baa baa black sheep, have you any wool?
Yes sir, yes sir, three bags full.
One for the master, one for the dame,
And, none for the little boy crying down the lane.
কালো ভেড়া তৎকালীন ইংল্যান্ডে ছিল দুর্ভাগ্যের প্রতীক, কারণ তার পশমে রং করা যেত না। সেই কালো ভেড়ার, অর্থাৎ দুর্ভাগ্যের রূপক পশমের ভাগ-বাটোয়ারা করছে। এক ঝুড়ি প্রভু, অর্থাৎ রাজা নেবেন। এক ঝুড়ি নেবেন ক্যাথলিক চার্চ। কিন্তু, যে মেষপালক সেই ভেড়াকে যত্ন করেছে, তার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। তাই, None for the little boy, crying down the lane।

গল্পের ছলে, শিশুদের উপভোগ্য ছন্দে এই নার্সারী রাইমসের স্রষ্টারা অসামান্য প্রতিভায় তুলে ধরেছেন তৎকালীন ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই প্রতিভাবানদের নামও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা জানিনা। তবে, আমার পাঠকদের কাছে অনুরোধ, ইউটিউবে যখন আপনার সন্তানের জন্যে নার্সারী রাইমস চালাবেন, আপনিও পাশে বসে মন দিয়ে শুনুন। আশা রাখি, হয়তো একঝলক ইতিহাস আপনারও চোখের সামনে ফুটে উঠবে।