নেদারল্যান্ডসে নবাগমন
অগ্নিভ সেনগুপ্ত
আমার প্রথম নেদারল্যান্ডসে আসার সুযোগ হয় ২০০৭ সালে। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরীতে ঢুকেছি, আর ঢুকেই অনসাইট – নেদারল্যান্ডস! বন্ধুরা জানালো, সেখানে সফ্ট ড্রাগস আর প্রস্টিটিউশন বৈধ – আর চিন্তায় রইলো যাতে আমি বিগড়ে না যাই। যাক, মাথায় সবার নির্দেশ-উপদেশ এবং ব্যাগে গরম জামা-ম্যাগির প্যাকেট-মিষ্টির বাক্স ভরে পাড়ি জমালাম। কলকাতা থেকে জেট এয়ারওয়েসে দিল্লী, সেখান থেকে কে-এল-এমে স্কিফোল এয়ারপোর্ট।
যেদিন নামলাম, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, সাথে ঝোড়ো হাওয়া। জুলাই মাসে কলকাতার ৪০ ডিগ্রি থেকে সোজা ৮ ডিগ্রিতে পদার্পণ। অসওয়ালের কলকাতা-স্ট্যান্ডার্ড মোটা জ্যাকেট এখানে কাজে আসবে না – নেদারল্যান্ডসে আমার প্রথম শিক্ষা। ভাগ্যিস আগের থেকে ক্যাব বুক করা ছিল, নাহলে ওই ঠান্ডায় এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে ক্যাব খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হতো।
পূর্বনির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছানোর পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নান করে পৌঁছে গেলাম এক দাদার বাড়ী, আগে থেকেই নেমন্তন্ন করে রেখেছিল যে! সেখানে ভাত-মাংস খেয়ে বেশ লম্বা একটা ঘুম, ফ্লাইটের ধকল আর ঠান্ডা ওয়েদারকে বাজিমাত করার মোক্ষম অস্ত্র।
পরদিন অফিস। সেই দাদার থেকেই শিখলাম যে এখানে ‘IJ’-এর উচ্চারণ হয় ‘Y’-এর মতো। তাই, প্রথম দিনেও আমাদের অফিসের মেট্রো স্টপ ‘BIJLMER’ নামটা উচ্চারণ করতে খুব-একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু, আমার নাম নিয়ে এখানকার লোকজনকে বেশ বেগ দিয়েছিলাম। এখানে ‘গ’-কে ‘খ’-এর মতো উচ্চারণ করে, তাই আমি ‘অগ্নিভ’ থেকে ‘আখনিভ’ হয়ে উঠলাম।
নেদারল্যান্ডসের কথা উঠলে এখানকার জল-নিকাশি ব্যবস্থার কথা বলতেই হয়। অনেকেই ছোটবেলায় ‘হান্সের বাঁধরক্ষা’ গল্প থেকে জেনেছেন যে নেদারল্যান্ডস দেশটা সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত। তাই, গোটা দেশ জুড়ে আছে ডাইক এবং ক্যানালের জালবিন্যাস। তবে, সেই ক্যানালগুলো শুধুমাত্র জল-নিকাশি ব্যবস্থা হিসাবে নয়, পর্যটন-শিল্পেও বিশাল ভূমিকা পালন করে। ক্যানাল-ক্রুস বা নৌকায় ক্যানাল-বিহার অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।যে কারণে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, আমার অ্যাপার্টমেন্টের পেছনেই ছিল একটা ক্যানাল। নেদারল্যান্ডসে গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া থাকে বেশ মনোরম (মাঝেমাঝে বৃষ্টি হয় যদিও)। ভালো ওয়েদার পেলেই চলে যেতাম সেই ক্যানালে মাছ ধরতে।
এই মর্মে মৎস্যশিকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কীকরণ: এখানে কিন্তু মাছ ধরতে গেলে লাইসেন্স লাগে। বিনা লাইসেন্সে মাছ ধরলে জেল ও জরিমানা।
আর, গ্রীষ্মে অন্যতম আকর্ষণ – সী বীচ। এখানে বিখ্যাত সী বীচ হচ্ছে দ্য হেগের স্কেভেনিনগেন, যেখানে সইফ-আলি খান ও রাণী মুখার্জ্জীর ‘হাম তুম’ সিনেমাটির শুটিংও হয়েছিল। আর আপনি যদি পরিবারের সাথে একটু একান্ত চান, তাহলে কাইকদাউন বা ক্যাটওয়াইক বীচ আপনার জন্যে আদর্শ।

কিন্তু আমরা তখন তরুণ তুর্কী, তাই দল বেঁধে একদিন চললাম স্কেভেনিনগেনে। কিছু সাহসী বন্ধু সেখানে বাঞ্জি জাম্পিং-ও করলো, বেশ হৈহৈ ব্যাপার। মাছভাজা-সহযোগে বিয়ার খেতে-খেতে সমুদ্র-স্নানের আনন্দ নিয়ে বেশ কেটে গেল একটা উইকএন্ড।
আর এখানে বিখ্যাত – কফিশপ। না, সেখানে লোকে কফি খেতে যায়না, বাবা ভোলেনাথের প্রসাদ খেতে যায়। আমার আবার শুকনো নেশা সহ্য হয়না, কিন্তু একবার গেলাম বন্ধুদের সাথে। দুঃখের কথা, কফিশপে বিয়ার পাওয়া যায়না। তাই, সবাই যখন ছিলিমে টান দিচ্ছে, আমি চুমুক মারছি কোলার গ্লাসে।
নেদারল্যান্ডসে ট্যুরিস্ট উপচে পড়ে এপ্রিল-মে মাসে, তার দুটো প্রধান কারণ। কিংস ডে, আর টিউলিপ গার্ডেন।
আমি যখন এখানে আসি, অর্থাৎ ২০০৯ সালে নেদারল্যান্ডসে রাণীর শাসন ছিল। তখন ৩০শে এপ্রিল উদ্জাপন করা হতো কুইনস ডে – রাণীর জন্মদিন।
২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় রাজার শাসন – কিং উইলেম আলেক্সান্ডার হলেন নেদারল্যান্ডসের রাজা। আর, সেই থেকে কুইনস ডে-র বদলে পালন করা হয় কিংস ডে বা ‘কোনিংস-দাগ’, ২৭শে এপ্রিল।
কিং হোক বা কুইন, এ হলো ফুর্তির উৎসব। যেহেতু এখানকার রাজপরিবারের ঘরানা হচ্ছে হাউস অফ অরাঞ্জে-নাসাউ, বা হাউস অফ অরেঞ্জ, সেহেতু অরেঞ্জ বা কমলা হচ্ছে এখানকার রয়াল কালার। তাই, রাজার জন্মদিনে পুরো নেদারল্যান্ডসের রঙ হয়ে ওঠে কমলা। রাস্তায় লোকজন কমলা জামাকাপড় বা সাজপোষাক পড়ে নাচ-গান-আনন্দের সাথে রাজাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। আর, পুরো নেদারল্যান্ডস সেদিন হয়ে ওঠে এক বিশাল ফ্লি মার্কেট। অনেকেই, বিশেষতঃ বাচ্চারা, নিজের ব্যবহৃত খেলনা-জামাকাপড়-বইপত্রের পসরা সাজিয়ে রাস্তায় বসে পরে বিক্রি করতে। আর, সেই বিকিকিনির বাজার সম্পূর্ণরূপে ট্যাক্স-ফ্রি!

এই সময়েই নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেনে ভীড় উপচে পড়ে। অমিতাভ বচ্চন-জয়া ভাদুড়ী-রেখা অভিনীত সিলসিলা-র গানটা মনে পড়ে, “দেখা এক খোয়াব তো য়েহ সিলসিলে হুয়ে..”? রঙিন টিউলিপের বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন নায়ক-নায়িকা, চোখ-জুড়ানো দৃশ্য। সেই টিউলিপ গার্ডেন!

তবে নেদারল্যান্ডসে, আদতে ইয়োরোপের বেশীরভাগ দেশেই আনন্দ-ফুর্তি-দেশভ্রমণের সময়টা খুব সীমিত। মোটামুটি অক্টোবর থেকে মার্চ মাস অবধি এখানকার আবহাওয়া থাকে ঠান্ডা, স্যাঁত্স্যাঁতে। আমি যদিও এখানে এপ্রিল মাসেও তুষারপাত দেখেছি, কিন্তু বসন্তকাল ও গ্রীষ্মকাল এখানে মনোরম ও আরামদায়ক।
গ্রীষ্মকালের আরেক মজা হচ্ছে, দিনের আলো থাকে প্রায় রাত দশটা-এগারোটা অবধি। তাই অফিস-স্কুল-কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেও অনেক সময় পাওয়া যায় উপভোগ করার জন্যে।

শীতকাল ঠিক এর উল্টো। সাড়ে-তিনটে কি চারটের মধ্যে অন্ধকার, কনকনে ঠান্ডা – বাড়ির থেকে বেড়নোর উপায় নেই।
তখন শুধু অপেক্ষা – আবার নতুন বছরের জন্যে, নতুন বসন্তের জন্যে।
৭ মে ২০১৯
** লেখার সমস্ত ছবি লেখকের নিজের তোলা