শেলী নন্দী
ইট দিয়ে আধ ভাঙা চৌকিটা আরো একটু উঁচু করে নিল জবা। অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে মাটিতে রাখা টিনের ট্রাঙ্কটা বার করতে একটু কষ্ট হল আজ। পুরনো কাঁথার নীচ থেকে বার করলো পুঁটলি টা। দুগাছি বালা, সোনার সরু চেন আর কয়েকটা একশো টাকার নোট। জবার এগুলো সম্পত্তি আর ট্রাঙ্কটা হল সিন্দুক।
শহরতলির খালপাড়ের এই এক কামরার ঘরে থাকে জবা,জবার পঙ্গু স্বামী,শাশুড়ী আর মেয়ে ফুলি।
সামনের একফালি বারান্দায় স্টোভ পাতা রান্নাঘর। ডিমের ঝোলের আলু খুন্তির মাথা দিয়ে টিপে দেখছিল ফুলি,সেদ্ধ হল কিনা।
ফুলিকে কাছে ডাকলো জবা।
দেখালো তার যত্নে রাখা সম্পত্তি।
———আমি কবে ফিরবো জানিনা দেখে রাখ এগুলো।
———তুমি তো কাল কলকাতা যাবে মা। তোমার তো কোনো শরীর খারাপ হয় নি তাহলে কেন অতদূরে ডাক্তার দেখাতে যাও?
কিছু প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘশ্বাসে লুকিয়ে থাকে। ছলছলে চোখের ভাষা পড়ার মত বড় হয়নি ক্লাস সিক্সের ফুলি। মায়ের এই নীরবতার ঠিকানা খুঁজে পায় না সে।
জবা আজকাল অন্যমনস্ক থাকে প্রায়ই।
কালকের পর আগামী দিন গুলো কেমন কাটবে? আত্মীয় স্বজনরা কিভাবে নেবে এই সিদ্ধান্ত? সামনের যাত্রাপথে আলো আঁধারী খেলা অনেক।
স্কুলমুখো না হওয়া জবা প্রথমটায় কিছুই বুঝতো না কিন্তু এখন মগজস্থ হয়েছে অনেকটা।
~~~~~~~~
মাস তিনেক আগের কথা।
তিন বাড়ীর ঠিকে কাজ সেরে পাড়ার ওষুধের দোকানে গিয়েছিল জবা। ওখানেই আরতির সাথে দেখা হয় হঠাৎ। বাপের বাড়ীর দেশের লোকের সাথে গল্প হয় ফেরার পথে বেশ খানিক।
বেশভূষায় চোখে লাগা পার্থক্য টুকু আকর্ষণের বিষয় হয়ে ধরা দিয়েছিল জবার কাছে।
ধীরে ধীরে সখ্যতা বাড়ে আর নতুন এক জগতের সন্ধানী আলো এসে পড়ে জবার জীবনে।
আরতি দালালির কাজ করে এখন। বেশ মুনাফার কাজ। সন্তানহীন দম্পতি আর গর্ভধার দেওয়া মা এর মধ্যেকার সেতু হয়ে কাজ করে সে। কলকাতার স্বল্পনামী এক ইনফার্টিলিটি সেন্টারের সাথে যুক্ত সে। আইনী নিয়মের খুঁটিনাটি বিষয় আর গোটা ব্যাপারটা অভাবী মহিলার কাছে জানানো আর স্বপ্নবৎ মোটাসোটা অর্থলাভের ছবি আঁকার কাজ করে আরতি।
টেনেটুনে বয়ে নিয়ে যাওয়া অভাবের সংসার,পঙ্গু স্বামীর না হওয়া চিকিৎসা,ফুলির জন্য একটা অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ একদিকে যখন জবার কপালে চিন্তার ছায়াপাত করে তখন গর্ভধার দিয়ে উপার্জিত মোটা টাকা সেই ছায়ায় আলোর দিশারী হয়ে জবার চোখে স্বপ্ন আঁকে।
বাড়ীতে জানায় সবটুকু।গররাজী থেকে নিমরাজী, নিমরাজী থেকে রাজী র পর্যায়ে আসে তাদের মতামত।
প্রাথমিক কথাবার্তা,আইনী নিয়ম রীতি পেরিয়ে এবার চিকিৎসা র শুরু।
লড়াকু মনে ভয়,দ্বিধা,দ্বন্দের ঝড় শেষ। এখন শুধু ঘরছাড়া এক সুখদুঃখের মোড়কে কাটানো বেশ কয়েক টা মাস।
~~~~~~~~
ভাতের ফ্যান পড়ছে হাঁড়ির গা বেয়ে। স্টোভের আগুনটা বেশ নিভুনিভু। তেল বাড়ন্ত।
রেশনের তেল আনার কাজটাও ফুলিকে করতে হবে কাল থেকে। সংসারের সব কাজ থেকে আপাত ছুটি এখন জবার। ছলছলে চোখদুটো এসে থমকায় পঙ্গু স্বামীর তেলচিটে বিছানায়।
তেলচিটে বিছানার গায়ে শুয়ে আছে জবার স্বামী। দুজনের দৃষ্টি বিনিময়ী নীরবতা অনেক না বলা কথা শুষে নিচ্ছে | দেওয়ালে ঝোলানো ওষুধের ব্যাগটা নামিয়ে ফুলিকে বুঝিয়ে দেয় ওষুধদের রোজনামচা।প্রেসক্রিপশনে দাগানো ওষুধ কিনতে হবে ফুরিয়ে গেলে।
——আরতি মাসি প্রতি মাসে টাকা দিয়ে যাবে ফুলি। বুঝেসুঝে খরচা করিস মা।
মা,তুমি কলকাতায় কতদিন থাকবে?
আরতি মাসি আমায় নিয়ে যাবে তোমার কাছে?
না না। তুই গেলে বাবাকে কে দেখবে মা?
ঠাকুমা একা পারবে না ফুলি।
আমি তো চলে আসবো কমাস পরেই।
বুকে টেনে নিয়ে মেয়েকে আদর করে জবা। ভালবাসার সুতোরা এভাবেই মুক্তো গাঁথে হ্যারিকেনের মৃদু আলোয়।
~~~~
ভোরের ট্রেনে চেপে এবার গন্তব্য কলকাতা।
ঝা চকচকে সেন্টার।
ইংরেজী জানা দম্পতি আর একরাশ অজানা ভয় সবাই জবার অপেক্ষায়।
প্রতিবারের মত এবারেও তার সঙ্গী আরতি।
আগেই তার পরিচয় হয়ে গেছে বড়লোক দম্পতির সাথে। লেক গার্ডেন্সের এক বহুতলের বাসিন্দা রাজীব সেন আর মধুরা সেন। আভিজাত্যের ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। চল্লিশ ছুঁইছুঁই মিসেস সেনের চোখে এক বুক আশার আলো উদ্বেগ আর উৎকন্ঠাদের ছাপিয়েছে আজ।
আজ জবার দেহের জমিতে প্রোথিত হবে সেন দম্পতির যত্নে রাখা বীজ।
আধুনিক চিকিৎসা র হাত ধরে দুই পক্ষই নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গ আবাহনের অপেক্ষায়। এখন অঙ্কুরোদ্গমের সাফল্যের ফলাফলের জন্য দীর্ঘ এক মাস।
মিঃ আর মিসেস সেন বসে আছেন সেন্টারের ওটি র সামনে।
———“ট্রান্সফার” ইস ডান অ্যান্ড পেশেন্ট ইস পারফেক্টলি ওকে মিঃ সেন।
ডক্টর সরকার আশ্বস্ত করলেন।
দুধ সাদা বিছানায় শুয়ে আছে জবা। হালকা ঝিমুনি ভাব সাথে হালকা দুশ্চিন্তা। মধুরা সেনের মেনিকিওর করা ফর্সা হাতের ছোঁয়ায় গতর খাটা কেজো জবার খানিক অস্বস্তি হল।
আজ থেকে ভীষণ যত্নে আর সাবধানে থাকতে হবে ….
বুঝিয়ে দিলেন তিনি| জবার মুখে হালকা হাসি|
সদ্য ওঠা ঘামাচিরা এসি র হাওয়ায় আজ বেশ শান্ত। নতুন নাইটি আর টুকিটাকি প্রসাধনী সব দিয়ে গেছে মিসেস সেন।
আজ থেকে টিনের এক কামরা ঘরের জবার আস্তানা আরামপ্রদ বাতানুকূল ঘরে।
নার্সদের সেবা শুশ্রুষায় কাটবে সামনের দিনগুলো। অভাবী পেট গোগ্রাসে গিলবে পুষ্টিকর খাবার দাবার। ঠিকে কাজের জবার এখন আয়েস করা জীবন ।
তবু কেন দুঃখ আর অবসাদ গুলো ঠেলেঠুলে ঢুকছে জবার মনের অন্দরে?
পঙ্গু স্বামীর অসহায় মুখ,ফুলির ছেঁড়া বইখাতা,শাশুড়ীর ঘোলাটে চোখ এদের নিয়েই তো জবার জীবনধারণ। প্রথম কিস্তির টাকাও কাল পেয়ে যাবে জবার শ্রীহীন সংসার।
মিসেস সেনের দিয়ে যাওয়া প্যাকেট টা বেশ ভারী। দামী শ্যাম্পু ,পাউডার,তেল, সাবান এপাশ ওপাশ করে জরিপ করতে থাকে জবার চোখ। আরতির হাতে পাঠিয়ে দেবে কিছু জিনিস ফুলির জন্য। বালিশের তলায় রেখে দেওয়া ফুলির ফটোটাও খুব খুশী এই প্রাপ্তিতে।
ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে কাটলো নার্সিংহোমের প্রথম রাত। সকালের শুরুটা অভ্যস্ত ব্যস্ততার ঠিক বিপরীত। জলমুড়ি,বাসি রুটি,পান্তো ভাতের সকালে আজ জ্যাম জড়ানো ব্রেড,কলা,ডিম সেদ্ধ আর এক গ্লাস দুধ। এত কিছু তো গোটা দিনেও কোনদিন পেটে পড়ে নি জবার।
অভাবের সংসারে জল মেশানো দুধটুকু বাপ বেটির জন্য বরাদ্দ। জবা তো জনম দুখী।
বাপের ঘরে পাঁচ নম্বর মেয়ের কপাল নিয়ে জন্ম তার।
বিয়ের চার বছরের মাথায় স্বামীর পঙ্গুত্ব। উপযুক্ত চিকিৎসা তাদের মত সংসারে দুঃস্বপ্ন নিছক। জীবনের ফেলে আসা পৃষ্ঠাগুলো আজকাল স্মৃতিপথে খেলা করে বেড়ায়।
আলাদা কেবিনে রাখা হয়েছে জবাকে। ধোপ দুরস্ত পরিবেশের আনাচে কানাচে অপেক্ষারা বাসা বেঁধেছে। জবার কাছে না আছে মোবাইল না আছে তার ঘরে। ফুলি,ফুলির বাবা,অভাবী সংসার তাড়া করে বেড়ায় জবার নতুন জীবন অধ্যায়কে।
মিসেস সেন প্রায়ই আসেন জবার সাথে দেখা করতে। চোখে তৃষ্ণা আর বুকে ভালবাসা নিয়ে সে জবার যত্ন নেয়।
জবার ও এক একটা দিন কাটে পরম সুখে বুকে চিনচিনে একটা অভাব বোধকে সঙ্গী করে। মাঝে সাঝে চাতকী দৃষ্টিতে খুঁজতে থাকে সে আরতিকে। ফুলিরা কেমন আছে কে জানে?
সময়ের স্রোতে জীবন ধুয়ে নেয় তার টানা পোড়েনদের। থিতিয়ে পড়ে ইচ্ছে অনিচ্ছেরা। উদ্বেগ উচাটন উৎকন্ঠারা অবশেষে এসে পৌঁছায় নির্ধারিত দিনে। রক্ত পরীক্ষায় জানা যাবে সাফল্যের ঠিকানা। চিকিৎসার সাফল্য,জবার স্বপ্নের সাফল্য আর সেন দম্পতির প্রচেষ্টার সাফল্য আজ এক ই সুতোয় বাঁধা।
মিঃ সেন সকাল থেকেই পাশফেলের খবর নেওয়ার জন্য সেন্টারে হাজির। মিসেস সেন ঘরে আজ। থমথমে মুখ চোখ নিয়ে জবাও ভীষণ রকম উদগ্রীব। মঙ্গলচন্ডীর কাছে মানত রাখে জবা। সন্ধ্যা ছটার পর জানা যাবে রেজাল্ট। ঘুমহীন দুপুরের ক্লান্তি নিয়ে জবার অপেক্ষারা এভাবেই শ্বাস নেয় এসির ঠান্ডা ঘরে।
অপেক্ষাদের অবসানের যবনিকা পতন হয় অনেকাংশে। রিপোর্ট পসিটিভ কিন্তু এরপর ধারাবাহিক ভাবে আরো দুবার রক্ত পরীক্ষার পসিটিভ ফলাফলে সর্বত ভাবে নিশ্চিত হবে সাফল্যের শিরোপা।
আপাত খুশীর ঝলকে জবার মন ও বেশ ফুরফুরে।
মিঃ সেনের ফোনের অপেক্ষায় থাকা মধুরা সেন ও বেজায় খুশী। রং লাগে সকলের নিরলস প্রচেষ্টায়।
সামনের যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ। একে একে পাশ করে যায় ব্লাডটেস্ট গুলো।
জবার নতুন জীবনে নতুন চরিত্ররা।
মধুরা সেন রোজ আসেন ভিসিটিংস আওয়ারে।
দুই মা এখন দুই বন্ধু। আবেগ বিনিময়ের হাত ধরে দুজনের দূরত্ব কমতে থাকে বেশ খানিকটা।
ফুলির ছবি টা রোজ একবার করে দেখে জবা। বেড পরিষ্কার করার সময় নার্সের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর থেকে ছবিটা ব্যাগে রেখে দিয়েছে সে।
একটিবার আরতিকে জবা জানিয়েছিল মনের গোপন ইচ্ছে।
——ম্যাডাম খুব ভালরে আরতি। বল্লে ঠিক নিয়ে যাবে আমার বাড়ী। ওনাদের তো গাড়ী আছে। খুব সাবধানে যেতাম। দেখে আসতাম আমার সংসার।
——পাগল হলি জবা?
——এসব কথা ভুলেও ভাবিস না।
——কত্তদিন ফুলির মা ডাক টা শুনি না।
——ফুলির বাবার মাথায় হাত রাখি না।
——বুড়ী শাশুড়ীর সাথে ঝগড়া করি না।
মনের সাথে কথা বলে নেয় জবা।
আরতির সংসার নেই। পিছুটান নেই। এসব কথারা আরতির মন ছোঁবে না।
নিয়ম মতো ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত বন্দী জীবনকেই আপন করে নিতে হবে তার।
এখন তার দেহ ভাড়া নিয়েছে বড়লোক সেন দম্পতি। এই দেহে তিলতিল করে বেড়ে উঠবে তাদের সন্তান। তাদের আত্মজ।
জবা ভাড়া হিসেবে পেয়েছে বেশ মোটাসোটা টাকা। একটু করে যত্ন নিয়ে তাদের সন্তান আকার পাবে আর সেই অনুযায়ী সেও পাবে নির্ধারিত প্রাপ্য।
দেওয়া নেওয়ার সংসারে এ এক বিচিত্র খেলা।
দ্বিতীয় বারে মা হওয়া জবার এখন কঠোর অনুশাসন।
~~~~~~~~
প্রবল বমি বমি ভাব কদিন ধরেই।
গ্যাস অম্বলের চোরা চাহুনিতে শরীরী কষ্টগুলো মনের কষ্টগুলোকে ঢেকে রেখেছে অনেকটা।
দিন যত এগোচ্ছে মাতৃত্ব সুখ তত বেশী উপসর্গ দের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ফুলির মা এখন অন্য রকম মা। বিশ্রামময় সুখের জীবনে নিয়ম মেনে চলছে ডাক্তারী পরীক্ষা নিরীক্ষা। সঙ্গে ওষুধ পত্র আর পুষ্টিকর খাবার।
সময় আর জীবন এগিয়ে চলে আপন গতিতে সুখ দুঃখের সিঁড়ি পেরিয়ে।
প্রেগনেন্সির প্রথম পর্বের শেষের দিক। অনভিপ্রেত কিছু সমস্যার ছোবোলে আবার দুশ্চিন্তারাএসে বাসা বাঁধে।
আকস্মিক ভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিতে থাকে জবার
শরীরে। মাঝ রাতের নির্জন কেবিনে তখন অজানা ভয় আর কষ্টরা জবার ঘুম কেড়ে নেয়।
নার্সকে ডাক দেয় সে।
দুধ সাদা বেডশিটের অনেকটা জায়গা তখন লাল। রক্তে ভিজতে থাকে জবা আর তার কান্নারা।
“স্যার ৪ নং কেবিনের পেশেন্টের সাডেন কিছু প্রবলেম হচ্ছে। এক্ষুনি একবার আসুন।”
ইন্টারকমে ফোন করে দেয় নাইট ডিউটিতে থাকা নার্স। এমারজেন্সিতে তখন ডাঃ পালিত।
ছুটে আসেন তিনি।
বেডের উপর কুকড়ে শুয়ে আছে জবা।
তলপেট চেপে রেখেছে দু হাত দিয়ে। দামী জিনিস রক্ষার তাগিদটুকু ঠিকরে বেরোচ্ছে তার যন্ত্রণায়।
চটজলদি ওষুধ আর ইন্জেকশন দিলেন ডঃ পালিত। তৎপর নার্সেরাও জবার পাশে করে চলেছে সেই মুহূর্তের ডাক্তারী কর্তব্য।
বাইরের রাস্তায় তখন ঘুমন্ত শহরের নিস্তব্ধতা।
লেক গার্ডেন্সের সেভেন্থ ফ্লোরের বেডরুমে নিয়ন বাতির আলো মেখে নরম বিছানায় সেন দম্পতি।
শহর তলির এক কামরার গুমোট ঘরেও তখন অভাবী নিঃশ্বাসের রাত্রি যাপন।
জবার দেহমনের কষ্টরা আর হারিয়ে ফেলার অব্যক্ত যন্ত্রণারা ভীষণ একলা।
কাল সকালে স্ক্যান হবে। কেবিনের দুজন নার্সকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। বাকী রাতটা জবা জানে না তার নিজের অবশ যন্ত্রণার কথা।
ভোর বেলায় ফোনে মিঃ সেনকে সমস্তটা জানানো হলে তড়িঘড়ি ছুটে আসেন তারা।
একরাশ ক্লান্তি আর ভয় মেশানো চোখ নিয়ে জবার মুখে তখন অপরাধী অবসাদ।
উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার ভ্রূকুটিতে মিসেস সেনের মুখ থমথমে। নীচু গলায় মেয়েলি বাক্য বিনিময় হয় দুজনের। অলক্ষ্যে দুজন দুজনকে প্রবোধ দেয় যেন।
সকাল দশটা তখন ঘড়িতে। স্ক্যান রুমে জবা আর জনা চারেক ডঃ।
দাঁতে দাঁত চেপে বাইরে অপেক্ষায় মিঃ আর মিসেস সেন।
অযাচিত উদ্বেগ কালবৈশাখী সৃষ্টি করেছিল। ঝড় ঝাপটার পর স্ক্যানের রিপোর্ট শান্ত করে সকলকে।
—বেবি ঠিক আছে তো?
দুই মায়ের ই তৃষ্ণার্ত প্রশ্ন একটাই।
—বেবি পোজিশন একটু চিন্তার। একদম বেড রেস্ট এখন থেকে।
জবা আর মধুরা দুজনেই চিন্তিত।
ডঃ সরকার আশ্বস্ত করলেন খারাপ কিছু হয় নি। হাসি খুশী থাকাটা এখন বেশী ইম্পর্টেন্ট।
ছদ্ম খুশীর পর্দা টেনে জবা তার দুশ্চিন্তাদের আড়াল করলো।
সময়ের স্রোতে চলতে থাকে জীবন|
গলির চৌকাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় মুখোমুখি জবার বর্তমান|
মধুরা সেন তার দামী স্মার্টফোনের ওয়াল পেপারে সেট করে রেখেছেন গুগল জাত এক শিশুর ছবি।
—এটা কার ছবি দিদি?
প্রশ্ন করে জবা।
———এমন ফোন পছন্দ?
এমা না না। এতো বড় ফোন দিয়ে আমি কি করবো?
পরের দিন দুটো ছোট ফোন জবার হাতে তুলে দেয় মিসেস সেন।
একটা তোমার আর একটা তোমার বাড়ীর।
স্বপ্নসুখে ভাসতে থাকে জবা। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে তার সমস্ত শরীর।
পবিত্র হাসিটুকু দুই মা ভাগাভাগি করে নেয়।
চিকিৎসা আর যত্ন নিয়ে এগোতে থাকে জবার ভাড়াটে মাতৃত্ব।
আরতির হাতে পাঠানো ফোনে জবা খোঁজ নেয় তার নড়বড়ে সংসারের।
——মা আমি পাশ করে সেভেনে উঠেছি।
——আমরা এখন গোটা ডিমের ঝোল খাই।
——দুধে আর জল মেশায় না ঠাকুমা।
——বাবার জন্য দামী ওষুধ গুলো কিনতে পারছি জানো?
এপাশে নির্বাক জবার চোখে একটা ঘুম ঘুম ছবি।
শ্রীহীন সংসার আদল পাচ্ছে একটু একটু করে। জবার পেটটাও এখন বেশ উঁচু।
বিকেলের দিকে কৎবেল মাখায় নুন চিনি লংকার সুসম সমাহারকে পরিতৃপ্তির সাথে চেটে খাচ্ছিল জবা। মধুরা সেন এখন জবার মধু দিদি। ছোটখাট ইচ্ছে প্রাপ্তি ঘটায় মিসেস সেন।
ফুলি হওয়ার সময় জবার মা তেঁতুল মাখা করে দিত। মা আর নেই। কিডনির অসুখে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে সে।
আজন্ম অভাব কে আঁকড়ে ধরে বড় হয়েছে জবা।
এখন এই আরাম আর প্রাচুর্য তার কাছে আতিশয্য আর বোঝা মনে হয়। উপভোগ করতে অদ্ভুত কষ্ট হয়।
**********
সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মোড়কে কি কোন ত্যাগের চোরা কষ্ট এই ভাড়াটে মায়েদের আবেগের দরজায় আঘাত করে?
মাতৃত্ব নারীত্বকে সম্পূর্ণ করে। দৈহিক সীমাবদ্ধতা যখন মাতৃত্বের সাধ পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন আধুনিক চিকিৎসার হাত ধরে এই সব ভাড়াটে মারাই সন্তানহীন দম্পতির মুখে হাসি ফোটায়।
জবার মত দারিদ্র্যপীড়িত মায়েরাই মধুরা সেনদের উপহার দেয় ছোট্ট জীবনের অবয়ব|
নিজেরা আট নয় মাস যেভাবে গর্ভ ভাড়া দিয়ে সব কষ্ট টুকু শুষে নেয় তার বিনিময়ে তারা টাকা পায়।
তাও এককালীন নয়। কিস্তিতে কিস্তিতে পালা করে। দেনা পাওনার দুনিয়ায় এই দেওয়া নেওয়াটুকু কোন ঘৃণ্য ব্যাবসা নয়। তবু আমাদের সমাজ এই চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ টুকুকে গোপনীয়তার ঘোমটায় ঢেকে রাখে।
জবারা জোর গলায় ঘোষনা করতে পারেনা তাদের মাতৃত্ব।
সংসার পরিজন ছেড়ে গোপন আলোয় লুকিয়ে রাখে নিজেদের।
মধুরা সেনরাও তাই। অনেকেই সদর্পে ঘোষণা করতে লজ্জা পায় এই সন্তানলাভের বৃত্তান্ত।সযত্নে বর্ধিত গর্ভস্থ শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে প্রকৃত মাবাবার হাতে তুলে দিতে হয় ভাড়াটে মাকে।
দায়িত্ব কর্তব্য শেষ। দয়ামায়া আবেগদের গলা টিপে খুশী হতে হয় শেষ কিস্তির টাকা পেয়ে।
*************
আজ জবার ডেলিভারি ডেট। বিকেল ৫টায় ওটি। সকাল থেকেই সেন দম্পতি তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে উপস্থিত। জবার শরীরে বেড়ে ওঠা শিশুটির কান্নার শব্দ শুনতে পায় জবা। ফুটফুটে এক শিশুকন্যা জন্ম দিয়েছে জবা— ভাড়াটে মা।
মধুরা সেন এর চোখে অবসন্ন আনন্দ। শিশু কন্যাটিকে দেখার জন্য উন্মনা তার মন আর শরীর।
বেড এ দেওয়া হয়েছে জবা কে।
পাশে কাপড়ে জড়ানো চোখ বোজা এক ছোট্ট জীবন্ত পুতুল।
দুই মায়ের চোখেই জল।
দুজনেই ভীষণ খুশী।
চুক্তিরা আজ মুক্তির নেশায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে
ফুলির মা কে।