সাগ্নিক ভট্টাচার্য
যেটা ভাবছেন সেটা নয়। মনমোহনবাবু ও একই ভুলটা করেছিলেন। কিন্তু রঞ্জন রক্ষিত সেই ভুলটি শুধরে দিয়ে বলেন যে বাঙালির এক্কেবারে আসল পেটেন্টেড আবিষ্কার হলো রসগোল্লা নয়–”আড্ডা”। ভাবছেন মনোমোহনবাবু, রঞ্জন রক্ষিত এরা আবার কারা ? তাহলে আপনাদের মানিকবাবুর “আগন্তুক” ছবিটা আরেকবার দেখা দরকার। “আগন্তুকে” সত্যজিৎ রায় এক বড় বিচিত্র মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলেন গল্প বলার জন্য। ভালো করে যদি ভেবে দেখেন, দেখবেন পুরো ছবিতে কাহিনী এগোনোর জন্য কেবল এই আড্ডাকে হাতিয়ার করেছেন পরিচালক। গল্পের সিংহ ভাগ প্রকাশ পেয়েছে আড্ডার মাধ্যমে। এমনকি তার ক্লাইম্যাক্স, যা এখনকার Bollywood ফর্মুলায় হয়ে গেছে মারা-মারি ধর-পাকড়ে ভরপুর এক পেশিশক্তির প্রদর্শনী, তাও কিন্তু এক আড্ডার আসরকে ঘিরেই গড়ে ওঠে আগন্তুক ছবিটিতে। পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত-রূপী ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনমোহন মিত্রর সেই বাকযুদ্ধ।
ফরাসি টেলিভিশন-এর পক্ষ থেকে Pierre Andre Boutang-কে দেওয়া ১৯৮৯-এর এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে তিনি তাঁর সামাজিক ছবিগুলোতে হাতিয়ার করেছেন ”কথা” এবং মানুষের কথা বলার ক্ষমতাকে। তাই এই আড্ডা দেবার প্রবণতাকে যারা ‘মুখেণ মারিতং জগৎ’ বলে ব্যঙ্গ করেন তাদের সঙ্গে হয়তো মানিকবাবুর কিছু বিরোধ ঘটলেও ঘটতে পারে।
কিন্তু এই আড্ডার নিন্দা তো কেবল কুতার্কিক বা ‘বাঙালির শত্রু’-দের মধ্যেই আটকে নেই, যাকে দিয়ে শুরু করলাম, সেই রঞ্জন রক্ষিতের কথাতে তো নৃতাত্বিক মনমোহন মিত্র মহাশয়ও আড্ডাকে এক প্রকার আক্রমণ-ই করেছিলেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম হলো যে আড্ডা মেরে সময়ের অপচয়, কেবল অকর্মণ্য পরনিন্দা-পরচর্চা-প্রিয় বাঙালিদেরই মানায়। তার বক্তব্য বোঝাতে তিনি সেই ”আড্ডা” তে তোলেন বাঙালির সব থেকে প্রিয়পাত্র রবীন্দ্রনাথ-কে। সরাসরি challenge ছুড়ে জিজ্ঞেস করেন “রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দিতেন?”
- চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙ্গেছে
- মেয়েদের আড্ডার আটকাহনঃ দেশে বিদেশে
- পার্বণ প্রসঙ্গ
- এই গল্পটা পড়বেন না
- রাজভক্ত রবীন্দ্রনাথ?
ইতিহাসে কিঞ্চিৎ কাঁচা হওয়ায় সেইদিন রক্ষিত মশাই রক্ষা পান নি। স্বীকার করতে হয়েছিল–”রবীন্দ্রনাথ তো আড্ডা দিতেন না।” কিন্তু সত্যিই কি রবীন্দ্রনাথ আড্ডা-বিমুখ ছিলেন? নাকি আড্ডা ব্যাপারটাই এমন যেটা রবীন্দ্রনাথ করলে আর তাকে আড্ডা বলা চলে না?
আড্ডা ব্যাপারটার যে ছবি নৃতাত্বিক-মশাই তুলে ধরেছিলেন কবিগুরু সেই শ্রেণীটিকে চরম ব্যঙ্গ করেছিলেন ”দূরন্ত আশা” কবিতায়। আড্ডার আবার শ্রেণী-টেনি হয় না বলছেন? আপনি কখনো পাড়ার রোয়াকে চায়ের ভাঁড় হাতে মেয়েদের আড্ডা দিতে দেখেছেন? আর এমন অঘটন যদিবা দেখা যায়, তা কি আপনার অভিধানে আড্ডা বলে বিবেচিত হয়? আবার স্যুট-প্যান্ট-টাই পরা এক বঙ্গসন্তানদের দল যদি সেই চায়ের দোকানে বসে ”আড্ডা” মারে তাহলেও ব্যাপারটা কেমন কলাপাতায় বিরিয়ানি খাবার মতন লাগে না? আবার ভেবে দেখুন, আজকালকার হাল-ফ্যাশন-এর যে সব কফির দোকানগুলো গজিয়ে উঠেছে পাড়ায়-পাড়ায়, তাতে বসে যারা আড্ডা মারে তারা কিন্তু serious আড্ডা-বাজদের একেবারেই প্রিয়পাত্র নন।
আর সব শেষে এই আরেকটা বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেই নয়। পাড়ার মোড়ের রিক্সা-স্ট্যান্ডের রিক্সাওয়ালারা যদি যাত্রীর অভাবে, অবসর সময়ে জটলা করে, দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলে, বাজারের আগুন নিয়ে আলোচনা করে, তা কিন্তু বাঙালি ”ভদ্রলোক” মোটেই আড্ডা বলে অভিহিত করে না। অথচ খেয়াল করে দেখবেন, রিক্সাওয়ালাদের আড্ডা আর ভদ্রলোকের আড্ডার বিষয়বস্তুতে কিন্তু শতকরা ৭০ ভাগ সময়ে বিশেষ ফারাক থাকে না।
অর্থাৎ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে আড্ডার জাত আছে, জাতি আছে, শ্রেণী আছে। এই শ্রেণীকে রবীন্দ্রনাথ সহজে বর্ণনা করেছিলেন কিভাবে মনে পড়ে ?
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু ,
নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোটো বহরে বড়ো
বাঙালি সন্তান।
যারা হলো গিয়ে রবি ঠাকুরের ভাষায় :
অন্নপায়ী বঙ্গবাসী
স্তন্যপায়ী জীব
জন-দশেকে জটলা করি
তক্তপোশে ব’সে।
- ভালোবাসা কারে কয়
- ৫০-৫০
- বাংলার বিপ্লবী সৈনিক কানাইলাল দত্ত
- আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক ঝলকে
- রাস্তা পারাপার
দুঃখের বিষয় যে আমরা কথায়-কথায় সেই রবীন্দ্রনাথ-এর বাণী আওড়ালেও তাঁর পছন্দ-অপছন্দগুলো মোটেই নিজের করে নিই নি। আমরা আড্ডা দিতে দারুন ভালোবাসি! আর এইটে হলো গিয়ে আমার আড্ডার আসর। নানান বিষয়ে নানানভাবে আড্ডার খোরাক জোগানো এই পত্রিকার এই column-এর কাজ। মনে হল, এই আড্ডার প্রথম বিষয়টা হওয়া উচিত স্বয়ং ‘আড্ডা’ এবং তাই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এই আড্ডার বাবা-মা-ভাই-বোনেদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে, অপেক্ষায় থাকুন পরের পর্বের।
বেশ অন্যরকম বিষয়। ভালো লাগল।
ধন্যবাদ পিয়ালি গাঙ্গুলী। “সময়”এর সঙ্গে থাকুন আর ও লেখার জন্য।
Muchmuche mochotkar lekha
ধন্যবাদ রনিতা বিশ্বাস। “সময়”এর সঙ্গে থাকুন আর ও লেখার জন্য।